চীনের মহাপ্রাচীর কতটুকু সফল ছিল?
বর্তমানে চীন একটি স্বাধীন দেশ। দেশটিতে বিশাল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আধুনিক মারণাস্ত্রের সমাহার তো রয়েছেই। বর্তমানে কোনো প্রতিবেশী দেশই চীনে সামরিক হামলা চালানোর সাহস করবে না। কিন্তু একসময় মধ্য এশিয়ার দুধর্ষ যে যাযাবর গোষ্ঠীগুলো ছিল, তারা নিয়মিত চীনে আক্রমণ পরিচালনা করত। বিশেষ করে চীনের উত্তরাঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর উপর এই যাযাবর জনগোষ্ঠীগুলোর অত্যাচার চরমে পৌঁছালে তৎকালীন রাজবংশের কর্ণধাররা চিন্তায় পড়ে যান। তারা আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হন্ন হয়ে উপায় খুঁজতে লাগলেন। অনেকে পরামর্শ দিল- সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রতিরোধ করা হোক। কিন্তু তৎকালীন মোঙ্গল কিংবা জিয়ংনু জনগোষ্ঠীর যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে চীনা সামরিক বাহিনী ছিল চরম অসহায়। এজন্য শেষপর্যন্ত একমাত্র উপায় হিসেবে হাজার হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
কোনো কিছুর সফলতা পরিমাপ করতে গেলে ঠিক কোন উদ্দেশ্যে জিনিসটি তৈরি করা হয়েছে, সেই সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। চীনের বিখ্যাত মহাপ্রাচীর নির্মাণের পেছনে প্রধান কারণ ছিল সীমান্তরক্ষা। দেশটির উত্তরাঞ্চলে নিয়মিত যাযাবর অশ্বারোহী বাহিনী হানা দেয়ায় জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল, সেটা কোনো অংশেই কম ছিল না। তাই এমন এক প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যেটি অশ্বারোহী বাহিনীর গতিরোধ করতে সমর্থ হবে। এছাড়া প্রাচীরের প্রস্থ এমনভাবে রাখা হয়েছিল, যাতে করে প্রাচীরের উপর দিয়ে সীমান্তরক্ষীরা অনায়াসে হেঁটে যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্তের মাধ্যমে যেসব বিদেশি ব্যবসায়ী চীনে ব্যবসা করতে আসত, তাদের পণ্যের উপর কর আরোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে যেন রাজ্যের কোষাগারে যাতে কিছু অর্থ জমা হয়, এবং নজরদারির মাধ্যমে অবৈধ চোরাচালানের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, সেটি নিশ্চিত করাও ছিল এই দেয়াল নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য। তাছাড়া যখন হানদের উপর আক্রমণ চালানো হতো, তখন এই মহাপ্রাচীরকে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
যদি প্রশ্ন করা হয়, যে উদ্দেশ্যে (বাইরের শত্রুর হাত থেকে চীনকে রক্ষা করা) এই সুদীর্ঘ মহাপ্রাচীর স্থাপন করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এই মহাপ্রাচীর কতটুকু সফল হয়েছিল? তাহলে বলতে হবে, এই মহাপ্রাচীর এদিক থেকে শতভাগ সফল ছিল। চীনের উত্তরাঞ্চল দিয়ে যখনই যাযাবর অশ্বারোহী বাহিনীগুলো বিভিন্ন চীনা শহরে তান্ডবলীলা চালাতে অগ্রসর হয়েছিল, তখনই মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই প্রাচীর। তবে এই মহাপ্রাচীরের বাধা টপকিয়ে কখনোই যে তারা চীনের ক্ষতিসাধন করতে পারেনি, এমনটা কিন্তু নয়। এই মহাপ্রাচীর না থাকলে তাদের আক্রমণে চীনের উত্তরাঞ্চলের মানুষ ও সম্পদের ক্ষতিসাধন তো হতোই, এর পাশাপাশি চীনের স্বাধীনতাও হুমকিতে পড়ত। প্রায় দুই হাজার বছরের ব্যাপ্তিতে একমাত্র সেনানায়ক হিসেবে কুখ্যাত মঙ্গোলীয় বিজেতা চেঙ্গিস খান এই মহাপ্রাচীরের বাধা উপেক্ষা করে চীনে আক্রমণ ও ধ্বংসলীলা চালাতে সক্ষম হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু ছোটখাট ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সৈন্যরা এই প্রাচীরের বাধা উপেক্ষা করে চীনে আক্রমণ চালিয়েছিল। অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন, যদি চীনের তৎকালীন রাজারা মহাপ্রাচীর তৈরির উদ্যোগ না নিত, তাহলে আজকে চীনের অন্য এক ইতিহাস পড়তাম আমরা।
বর্তমানে আমরা যে চীনা মহাপ্রাচীর দেখি, সেটি মিং রাজবংশের আমলে সংস্কার করা মহাপ্রাচীর। এখন এটি পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলেও একসময় এই প্রাচীর ছিল চীনের রক্ষাকবচ। মূলত বাইরের শত্রুদের আক্রমণ রুখে দিতে দক্ষ চীনা তীরন্দাজরা সশস্ত্র টহল দিত এই প্রাচীরের উপর দিয়ে। পুরো মহাপ্রাচীরের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার, যার মধ্যে প্রায় ২৫,০০০ ওয়াচ-টাওয়ার রয়েছে। এই ওয়াচ টাওয়ারগুলোতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সৈন্যরা সবসময় শত্রুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকত। সাধারণত, ওয়াচ-টাওয়ারগুলো স্থাপন করা হতো পাহাড়ের উপরে, যাতে অনেক দূরের শত্রুর অবস্থানও দেখা যায়। যদি দিনের বেলায় শত্রুরা আক্রমণ করত, তাহলে ওয়াচ-টাওয়ারে অবস্থান করা বিশেষ সৈন্যরা আগুন জ্বালিয়ে বাকি ওয়াচ টাওয়ারের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি গ্রহণের বার্তা প্রেরণ করত। রাতে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে লণ্ঠন জ্বালিয়ে বার্তা দেয়া হতো।
“মহাপ্রাচীর নির্মাণ প্রকল্প’ ছিল পুরোটাই চীনা রাজতন্ত্রের খামখেয়ালিপূর্ণ একটি প্রকল্প। বিশ্বকে নিজেদের অর্থের ঝনঝনানি এবং প্রকৌশলগত উৎকর্ষ দেখানোর জন্য এই দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল”- এমন অভিযোগ করেন অনেকে। এটা সত্যি যে এই মহাপ্রাচীর নির্মাণে বিশাল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। কিন্তু সেটি না করলে চীনের স্বাধীনতা বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। যদি বাইরের শত্রুর হাত থেকে চীনকে রক্ষারর দিক থেকে এই প্রাচীরের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব করা হয়, তাহলে দেখা যাবে এই মহাপ্রাচীর সফল একটি প্রকল্প ছিল। আগেই বলা হয়েছে, এই প্রাচীর সবসময় যে বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছে, এমনটা নয়। কিন্তু তারপরও যে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা ও শত্রুদের গতিরোধ করতে সফল হয়েছে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিরোধ করতেও সক্ষম হয়েছে, সেই কথা বলাই বাহুল্য।
Language: Bangla
Topic: How successful was the great wall of China
Reference:
১) Did the Great Wall of China Work? - Travel China Guide
২) Did the Great Wall of China work? - Live Science
৩) Did the Great Wall of China Actually Keep Invaders Out? - Discover
৪) WAS THE GREAT WALL OF CHINA ACTUALLY EFFECTIVE? - Tutor Ming