জিডি করবেন কীভাবে? অনলাইনে এবং অফলাইনে সাধারণ ডায়েরি করার সহজ গাইড
সাধারণ ডায়েরি বা জিডি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া যা একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এটি কোনো ক্ষতি, হুমকি বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হারানোর ক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে। জিডি করার জন্য আপনাকে অনেক কিছু জানতে বা আইনি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। তবে সঠিক নিয়মকানুন জানা থাকলে এটি সহজেই এবং ঝামেলাহীনভাবে সম্পন্ন করা যায়।
এই প্রবন্ধে আমরা জিডি করার প্রয়োজনীয়তা, প্রক্রিয়া এবং অনলাইনে জিডি করার নতুন সুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন জিডি করবেন?
জিডি করার প্রধান কারণগুলো হলো:
নিরাপত্তাহীনতা বা হুমকির আশঙ্কা: যদি কোনো ব্যক্তি আপনাকে বা আপনার পরিবারের জানমালের ক্ষতি করার হুমকি দেয়, তবে জিডি করা জরুরি। এটি ভবিষ্যতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে পুলিশকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করে।
গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র হারানো: আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, চেক বই, লাইসেন্স, শিক্ষাগত সনদ বা অন্য কোনো মূল্যবান কাগজপত্র হারিয়ে গেলে জিডি করা আবশ্যিক। এটি ভবিষ্যতে ওই কাগজপত্রগুলোর অপব্যবহার ঠেকায় এবং নতুন করে পেতে সহায়তা করে।
ভবিষ্যতে আইনি সহায়তার জন্য: কোনো ঘটনা ঘটার আগে বা পরে জিডি করে রাখলে তা ভবিষ্যতের আইনি পদক্ষেপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে কাজ করে। এটি দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে এবং আইনি সাহায্য পেতে সহায়তা করে।
মনে রাখতে হবে, জিডি এবং অভিযোগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জিডি করা হয় সাধারণত কোনো ঘটনা ঘটার আগেই আশঙ্কা বা ভয় থেকে, আর অভিযোগ দায়ের করা হয় কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর। তবে অনেক সময় গুরুতর জিডিকে অভিযোগ হিসেবেও গণ্য করা হতে পারে।
অফলাইনে জিডি করার পদ্ধতি
অফলাইনে জিডি করার প্রক্রিয়া বেশ সহজ। এর জন্য আপনাকে নির্দিষ্ট কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে:
১. থানা নির্বাচন: যে এলাকায় ঘটনা ঘটেছে বা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে, সেই এলাকার থানায় জিডি করতে হবে। এটি জিডির কার্যকরতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
২. জিডি লেখা: জিডিটি থানার অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) বরাবর লিখতে হবে। আপনি নির্ধারিত ফরমে অথবা সাধারণ কাগজে হাতে লিখে আবেদন করতে পারেন। আবেদনপত্রে অবশ্যই আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য এবং যে কারণে জিডি করছেন তার বিস্তারিত বিবরণ (যেমন—হুমকির কারণ, হুমকিদাতার নাম, ঠিকানা, তারিখ, স্থান ইত্যাদি) উল্লেখ করতে হবে। কোনো কিছু হারিয়ে গেলে সেটির বিস্তারিত বিবরণ এবং সম্ভব হলে একটি ফটোকপি সংযুক্ত করুন।
৩. দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহযোগিতা: জিডি লেখার ক্ষেত্রে কোনো পরামর্শের প্রয়োজন হলে বা নিজে লিখতে না পারলে থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তার সহযোগিতা নিন। তিনি আপনাকে বিনামূল্যে সাহায্য করতে বাধ্য। এর জন্য কোনো ধরনের টাকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
৪. জিডির অনুলিপি সংগ্রহ: জিডি জমা দেওয়ার পর আপনাকে একটি অনুলিপি দেওয়া হবে। এতে জিডি নম্বর, সময়, তারিখ এবং কর্তব্যরত কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও সিল থাকবে। এই অনুলিপিটি নিজের কাছে যত্ন করে রাখুন, এটি ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিডি পাওয়ার পর পুলিশ যদি মনে করে ঘটনাটি কার্যকর, তাহলে তারা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
অনলাইনে জিডি করার নতুন সুবিধা
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এখন থেকে অনলাইনে জিডি করার সুবিধা চালু করা হয়েছে। গত ২১ জুন ২০২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অনলাইন জিডি’ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে শারীরিকভাবে থানায় না গিয়েও ঘরে বসে জিডি করা সম্ভব।
অনলাইনে জিডি করার প্রক্রিয়া:
১. রেজিস্ট্রেশন:
প্রথমে Google Play Store থেকে ‘অনলাইন জিডি’ অ্যাপটি ডাউনলোড করুন অথবা পুলিশের ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
‘রেজিস্ট্রেশন’ এ ক্লিক করে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা জন্ম নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করুন।
আপনার বর্তমান ঠিকানা, একটি লাইভ ছবি এবং মোবাইল নম্বর (যা আপনার ইউজারনেম হবে) ও ইমেল ঠিকানা (যদি থাকে) দিন এবং একটি পাসওয়ার্ড সেট করুন।
আপনার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মোবাইলে একটি ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (OTP) আসবে, যা সঠিকভাবে পূরণ করতে হবে।
২. লগইন ও অভিযোগের ধরন নির্বাচন:
সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন করার পর আপনার মোবাইল নম্বর এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করুন।
অভিযোগের ধরন নির্বাচন করুন (যেমন—হারানো বা হুমকির জিডি)। এরপর যে জেলা এবং থানায় জিডি করতে চান, তা নির্বাচন করুন।
ঘটনার স্থান, সময় ও তারিখ উল্লেখ করে ‘পরবর্তী’ বাটনে ক্লিক করুন।
৩. তথ্য পূরণ ও সাবমিট:
আপনার বর্তমান ঠিকানা এবং ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিন।
অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো কাগজপত্র থাকলে তা সংযুক্ত করুন।
সবকিছু ঠিক থাকলে ‘সাবমিট’ বোতামে ক্লিক করুন। ফর্মে কোনো ভুল থাকলে ‘সম্পাদনা’ বাটনে ক্লিক করে সংশোধন করতে পারবেন।
আবেদন সম্পূর্ণ হলে আপনি একটি অনন্য কিউআর কোড পাবেন। এই কিউআর কোড ব্যবহার করে আপনি জিডির ডিজিটাল বা প্রিন্ট করা কপি সংগ্রহ করতে পারবেন। আপনার আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা জানতে আপনি যেকোনো সময় ওয়েবসাইটে লগইন করতে পারেন।
জিডি সম্পর্কে পুলিশ আইন, ১৮৬১-এর ৪৪ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ও ১৫৫ ধারা অনুসরণ করা হয়। অনলাইন জিডি পদ্ধতি এই প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক ও সহজ করে তুলেছে, যা নাগরিকদের জন্য একটি বড় স্বস্তি।
0 Comments