১. নির্বাহী সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত স্বাধীনতার পর থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিশেষত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান এবং জনস্বাস্থ্য সূচকসমূহে। গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে আন্তর্জাতিকভাবে এই সাফল্য স্বীকৃত। তবে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এবং ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (Universal Health Coverage বা UHC) অর্জনের পথে বাংলাদেশ বর্তমানে গুরুতর কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য অর্থায়নে দুর্বলতা, যার ফলস্বরূপ মোট ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ নাগরিকদের নিজস্ব পকেট থেকে আসে 
২. ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ
২.১. স্বাস্থ্যসেবা: সাংবিধানিক অধিকার এবং উন্নয়নের অপরিহার্যতা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে 
২.২. স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক সাফল্য
স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে 
- জনস্বাস্থ্য সূচকসমূহে উন্নতি: বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সূচকগুলোতে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ থেকে ৭৩ বছর - টিকাদান কর্মসূচির শ্রেষ্ঠত্ব: Expanded Program on Immunization (EPI) কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বব্যাপী অন্যতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে - কমিউনিটি ক্লিনিক (CC) মডেল: তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্থাপিত ১৩,৫০০টি ক্লিনিকের মধ্যে ইতি মধ্যেই ১২,২৪৮টি চালু করা হয়েছে - ফার্মাসিউটিক্যাল স্বনির্ভরতা: ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে 
২.৩. বর্তমান পরিস্থিতি: নতুন চ্যালেঞ্জের আবর্তন এবং UHC লক্ষ্যমাত্রা
প্রাথমিক সংক্রামক রোগ (Communicable Diseases) মোকাবেলায় সাফল্য অর্জিত হলেও, দেশে এখন অসংক্রামক রোগ (NCDs)—যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এবং ক্যান্সার—প্রাধান্য বিস্তার করছে 
৩. স্বাস্থ্য খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাসমূহের গভীর বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রকট সংকট তৈরি করেছে স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা, দুর্বল মান এবং শ্রেণী, গোষ্ঠী, অঞ্চল ও লিঙ্গভেদে ব্যাপক বৈষম্য 
৩.১. স্বাস্থ্য অর্থায়ন সংকট এবং বিপর্যয়মূলক ব্যক্তিগত ব্যয়ের বোঝা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্বল অর্থায়ন এবং সরকারের অগ্রাধিকারের অভাব।
৩.১.১. সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা ও নীতিগত গুরুত্বের অভাব
সরকারি বাজেট বরাদ্দ থেকে দেশে প্রতি বছর স্বাস্থ্য সেবা বাবদ ব্যয়িত মোট অর্থের মাত্র ২৩ শতাংশ নির্বাহ করা হয় 
৩.১.২. আউট-অফ-পকেট (OOP) ব্যয়ের তীব্রতা
সরকারি বিনিয়োগের এই অপ্রতুলতা সরাসরি নাগরিকদের উপর আর্থিক বোঝা হিসেবে স্থানান্তরিত হয়। বাংলাদেশে নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকেই মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৬৯ শতাংশ) নির্বাহ করতে হচ্ছে 
এই বিপর্যয়মূলক ব্যয় (Catastrophic Health Expenditure) অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হলে তাকে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় বলা হয় 
টেকসই অর্থায়ন চ্যালেঞ্জের তুলনামূলক চিত্রটি নিম্নরূপ:
Table ১: স্বাস্থ্য অর্থায়ন চ্যালেঞ্জের তুলনামূলক চিত্র
| সূচক | বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা | বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড | দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থান | উৎস | 
| মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি অংশ (%) | ২৩% | ≥70% (UHC এর জন্য) | সর্বনিম্ন হারগুলির মধ্যে একটি | |
| জনগণের নিজস্ব পকেট থেকে ব্যয় (OOP) (%) | ৬৯% | <15−20% (আদর্শ) | দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ | |
| বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের হার (%) | ২৪.৭% পরিবার | 0% (UHC লক্ষ্য) | দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ | |
| স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি বরাদ্দ (%) | স্বল্প (বিশ্বের সর্বনিম্নগুলির একটি) | 5% | সর্বনিম্ন | 
৩.২. সুশাসন, দুর্নীতি ও সম্পদের অপচয়
স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের অপ্রতুলতার চেয়েও মারাত্মক সমস্যা হলো দুর্বল সুশাসন এবং সম্পদের চরম অপচয়। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হয় 
৩.২.১. বাজেটে অপচয় ও অদক্ষতা
সরকারি স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব প্রকট। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, কয়েক গুণ বেশি দামে প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে এবং উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় নিজেই অনেক সময় এমন চাহিদা তৈরি করে, যা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর প্রয়োজন নয় 
একটি গভীর বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়ন দক্ষতা কম থাকায় এবং ৩০ শতাংশ অপচয়ের কারণে সরকার স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে আগ্রহী হচ্ছে না, যা এক ধরনের নেতিবাচক চক্র সৃষ্টি করে 
৩.২.২. অবকাঠামো নির্মাণ বনাম কার্যকর সেবা
উন্নয়ন বরাদ্দের বড় অংশ অপ্রয়োজনীয় নির্মাণে ব্যয় হয়। বাজেটের ৩০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় নতুন ভবন নির্মাণে, যেখানে বিদ্যমান অবকাঠামোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম 
Table ৩: স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য এবং সুশাসন ঘাটতি
| চ্যালেঞ্জ ক্ষেত্র | পরিসংখ্যান/প্রমাণ | তাৎপর্য | উৎস | 
| বাজেট অপচয়ের হার | ~৩০% বার্ষিক অপচয় | সম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ঘাটতি | |
| অব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি | নতুন কেনা ৪০% | ভুল ক্রয় ও অপ্রয়োজনীয় চাহিদা | |
| গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তার প্রাপ্যতা | ২৫% কেন্দ্রে | সেবার সমতায় তীব্র বৈষম্য | |
| নতুন হাসপাতাল উদ্বোধনে বিলম্ব | ৪৫% জনবল/ইউটিলিটির অভাবে | উন্নয়ন বরাদ্দের অদক্ষতা | |
| স্বাস্থ্যখাতের জাতীয় বাজেট অগ্রাধিকার | ৮ নম্বরে | নীতিনির্ধারণী স্তরে গুরুত্বের অভাব | 
৩.৩. সেবার মান ও সমতার অভাব
স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও মানের মধ্যে তীব্র অসামঞ্জস্য বিদ্যমান, যা শ্রেণী, গোষ্ঠী এবং অঞ্চলভেদে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে 
৩.৩.১. শহর-গ্রাম বৈষম্য ও দুর্বল প্রবেশগম্যতা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শহর ও গ্রাম অঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য প্রকট। Bangladesh Health Watch-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় ৬৭% স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাওয়া যায়, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় এই হার মাত্র ২৫% 
৩.৩.২. দুর্বল রেফারেল পদ্ধতি ও দ্বিতীয় স্তরের অব্যবস্থাপনা
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কাঠামোবদ্ধ রেফারেল পদ্ধতির দুর্বলতা একটি প্রকট সংকট 
৩.৩.৩. বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যায়ন
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলির প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। এই বেসরকারি খাতের সেবা উচ্চমানের হলেও, তা অধিকাংশ জনগণের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী নয় 
৩.৪. মানবসম্পদ সংকট ও ব্যবস্থাপনা
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে পর্যাপ্ত ডাক্তার, দক্ষ নার্স, এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা 
৩.৪.১. তৃণমূল কর্মীর অনিশ্চয়তা ও মাইগ্রেশন
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (CHCP) মডেল প্রাথমিক সেবার ভিত্তি হলেও, CHCP-দের চাকরির স্থায়িত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক CHCP চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, কারণ তাদের চাকরি এখনও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টে ন্যস্ত করা হয়নি 
৩.৪.২. পদায়ন ও গ্রামীণ এলাকায় ধরে রাখার দুর্বলতা
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক ও দক্ষ কর্মীদের ধরে রাখার জন্য কার্যকর প্রণোদনা নীতির অভাব রয়েছে। এই কারণে গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তারের উপস্থিতি মাত্র ২৫%। যদিও ১,৪০১ জন মিডওয়াইফ নিয়োগ ও পদায়ন করা হয়েছে 
৪. সমাধানের কৌশলগত রোডম্যাপ: UHC ২০৩২ অর্জনের ভিত্তি
২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য খাতে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। এই রোডম্যাপ চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া উচিত: অর্থায়ন সংস্কার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ, সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন।
৪.১. টেকসই অর্থায়ন মডেল প্রবর্তন
৪.১.১. বাজেট অগ্রাধিকার ও কৌশলগত বরাদ্দ
স্বাস্থ্য খাতকে রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের শীর্ষে নিয়ে আসতে হবে। অবিলম্বে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন 
বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য কৌশলগত ক্রয় (Strategic Purchasing) ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক 
৪.১.২. জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা (National Health Insurance Scheme) প্রবর্তন
ব্যক্তিগত ব্যয়ের বোঝা কমাতে এবং আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি ব্যাপক, বাধ্যতামূলক এবং জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কাঠামো ডিজাইন করা অপরিহার্য 
৪.২. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও রেফারেল ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ
৪.২.১. কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলের স্থায়িত্ব ও সক্ষমতা বৃদ্ধি
কমিউনিটি ক্লিনিক (CC) মডেলকে কেবল মৌলিক সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে NCDs মোকাবেলার প্রথম স্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস রোগে সেবনযোগ্য ঔষধের নিয়মিত সরবরাহ এবং স্ক্রিনিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা প্রয়োজন 
৪.২.২. কার্যকর কাঠামোবদ্ধ রেফারেল ব্যবস্থা
কাঠামোবদ্ধ রেফারেল কৌশলগুলোর কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যা সিসি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (UHC) এবং জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত সুসংগঠিত হওয়া উচিত 
৪.৩. সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ
৪.৩.১. দুর্নীতি প্রতিরোধ ও স্বচ্ছতা
স্বাস্থ্য খাতে ৩০ শতাংশ বাজেট অপচয় রোধের জন্য ক্রয় এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কঠোর তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষা (Audit) এবং ডিজিটাল ট্র্যাকিং বাধ্যতামূলক করতে হবে 
বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স প্রদান এবং তাদের সেবার মান নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা আবশ্যক 
৪.৩.২. নজরদারি ও মূল্যায়ন (Monitoring and Supervision)
মাঠ পর্যায়ে সেবার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য টেকনিক্যাল সুপারভিশনের মাধ্যমে নজরদারি ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে 
৪.৪. স্বাস্থ্য মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ধরে রাখা
৪.৪.১. CHCP-দের প্রতিষ্ঠানিকীকরণ
কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে CHCP-দের চাকরি দ্রুত নিয়মিতকরণ করে তাদের নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের চাকরি ছেড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য এটি একটি মৌলিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ 
৪.৪.২. গ্রামীণ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন
গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনবল (ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ) ধরে রাখার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা, অগ্রাধিকারমূলক পদোন্নতি, এবং মানসম্মত আবাসন সুবিধা সংবলিত একটি গ্রামীণ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন করতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তার প্রাপ্যতা (২৫%) এবং শহরে ডাক্তার প্রাপ্যতা (৬৭%) এর মধ্যে বিদ্যমান তীব্র বৈষম্য দূর করতে এই প্রণোদনা নীতি অত্যন্ত জরুরি 
৪.৪.৩. দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিশেষজ্ঞতা
চিকিৎসা গবেষণার ওপর নিরন্তর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন 
৫. সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (UHC) অর্জনের পথ (Pathway to UHC 2032)
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার তিনটি মাত্রা—জনসংখ্যা কভারেজ, সেবার ব্যাপ্তি এবং আর্থিক সুরক্ষা—অর্জনের জন্য একটি সমন্বিত কৌশল বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
৫.১. সেবার ব্যাপ্তি সম্প্রসারণ
স্বাস্থ্যসেবার আওতা কেবল সংক্রামক রোগ বা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অসংক্রামক রোগ (NCDs), মানসিক স্বাস্থ্য, এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবার আওতা তৃণমূল পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা উচিত 
৫.২. তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
সকলের জন্য স্বাস্থ্য আইডি (Health ID) সহ একটি আন্তঃ-চালিত, ডেটা-নির্ভর স্বাস্থ্য তথ্য সিস্টেম তৈরি করা UHC অর্জনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ 
৫.৩. নতুন বৈশ্বিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ডেঙ্গু পরিস্থিতির মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) মোকাবেলার জন্য সরকারকে একটি 'এক স্বাস্থ্য পদ্ধতি' (One Health Approach) প্রচার করতে হবে 
৬. উপসংহার এবং চূড়ান্ত সুপারিশমালা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত মৌলিক জনস্বাস্থ্য সূচকগুলোতে প্রভূত সাফল্য অর্জন করলেও, এটি এখন একটি গুরুতর কাঠামোগত পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার পর থেকে অর্জিত সাফল্যগুলো বর্তমানে অর্থায়ন, সুশাসন এবং সেবার মানের তীব্র বৈষম্যের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় (৬৯%) এবং বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের (২৪.৭%) হার জনস্বাস্থ্যের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চরম আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
২০৩২ সালের মধ্যে UHC অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে, সরকারের জন্য নিম্নলিখিত চূড়ান্ত সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হলো:
১. অর্থায়ন বিপ্লব: স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের একটি আইনি ও কৌশলগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা। জনস্বাস্থ্য ব্যয় ২৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৫০ শতাংশে উন্নীত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা। ২. জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা প্রবর্তন: জনগণের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে খণ্ডিত প্রকল্প বাদ দিয়ে একটি ব্যাপক এবং বাধ্যতামূলক জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কাঠামো তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করা। ৩. সুশাসন ও অপচয় রোধ: ক্রয় ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে কঠোর তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষা ও ডিজিটাল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ বাজেট অপচয় রোধ করা। নবনির্মিত স্থাপনাগুলিতে ৪৫ শতাংশ বিলম্বের কারণ প্রশাসনিক দুর্বলতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। ৪. মানবসম্পদ স্থিতিশীলতা: গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তারদের ধরে রাখার জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন এবং CHCP-দের চাকরি দ্রুত নিয়মিতকরণ করে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৫. রেফারেল ব্যবস্থা ও NCD সক্ষমতা: কমিউনিটি ক্লিনিককে NCD স্ক্রিনিং ও প্রাথমিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র হিসেবে শক্তিশালী করা এবং রেফারেল চেইনকে শক্তিশালী করার জন্য উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে জনবল ও সরঞ্জামাদির পূর্ণ সক্ষমতা নিশ্চিত করা।
0 Comments