ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন: সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং ২০৩২ সালের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা রোডম্যাপ

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন: সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং ২০৩২ সালের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা রোডম্যাপ


১. নির্বাহী সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত স্বাধীনতার পর থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিশেষত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান এবং জনস্বাস্থ্য সূচকসমূহে। গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে আন্তর্জাতিকভাবে এই সাফল্য স্বীকৃত। তবে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) এবং ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (Universal Health Coverage বা UHC) অর্জনের পথে বাংলাদেশ বর্তমানে গুরুতর কাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মূলে রয়েছে স্বাস্থ্য অর্থায়নে দুর্বলতা, যার ফলস্বরূপ মোট ব্যয়ের ৬৯ শতাংশ নাগরিকদের নিজস্ব পকেট থেকে আসে , যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় সৃষ্টি করেছে । একই সাথে, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এবং শহর-গ্রামের সেবার মানের তীব্র বৈষম্য একটি কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা বিতরণ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই প্রতিবেদনটি এই মৌলিক সমস্যাগুলোর গভীর বিশ্লেষণ করে একটি কৌশলগত রোডম্যাপের রূপরেখা দেয়, যা স্বাস্থ্যসেবাকে একটি সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা স্কিম প্রবর্তন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়।   

২. ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ

২.১. স্বাস্থ্যসেবা: সাংবিধানিক অধিকার এবং উন্নয়নের অপরিহার্যতা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জনগণের পুষ্টিস্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে । স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ কেবল একটি মানবিক মৌলিক অধিকার নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কোনো দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটলে বোঝা যায় দেশটি অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে চলেছে । স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নার্সিং সেবা পরিদপ্তর এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সরকারি খাতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে । সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে    

২.২. স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক সাফল্য

স্বাধীনতার পরবর্তী দশকগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে । ২০০০ সালে জাতিসংঘের ১৮৯টি সদস্য দেশ কর্তৃক ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের (MDGs) ৮টি ক্ষেত্রের মধ্যে ৫টি ক্ষেত্রই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ছিল (১, ৪, ৫, ৬, এবং ৭), যার অর্জনে বাংলাদেশ সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে    

  • জনস্বাস্থ্য সূচকসমূহে উন্নতি: বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সূচকগুলোতে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ থেকে ৭৩ বছর , যা ২০০৫-০৬ সালের ৬৫ বছর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি । মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি ১ লাখ জন্মে ১৬৩-এ নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে , এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জন্মে ২৮-এ নেমে এসেছে    

  • টিকাদান কর্মসূচির শ্রেষ্ঠত্ব: Expanded Program on Immunization (EPI) কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বব্যাপী অন্যতম আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে । টিকাদান কর্মসূচির কভারেজ প্রায় সার্বজনীন: যেমন BCG ৯৮%, Penta 3 ৯৯%, এবং Measles Rubela ৯৮%    

  • কমিউনিটি ক্লিনিক (CC) মডেল: তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে স্থাপিত ১৩,৫০০টি ক্লিনিকের মধ্যে ইতি মধ্যেই ১২,২৪৮টি চালু করা হয়েছে । এসব কেন্দ্রে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য, টিকাদান কর্মসূচি এবং পরিবার পরিকল্পনা সহ ৩০ ধরনের ঔষধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে । ১৩,২৪০ জন CHCP নিয়োজিত থাকা এসব কেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষাধিক মানুষ সেবা নিয়েছে এবং প্রতিদিন গড়ে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ সেবা গ্রহণ করছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই মডেলটিকে সফল ও বাস্তবসম্মত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে    

  • ফার্মাসিউটিক্যাল স্বনির্ভরতা: ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষধ নীতি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে । বর্তমানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ উৎপাদন করছে, যার মান বিশ্বমানের বলে স্বীকৃত    

২.৩. বর্তমান পরিস্থিতি: নতুন চ্যালেঞ্জের আবর্তন এবং UHC লক্ষ্যমাত্রা

প্রাথমিক সংক্রামক রোগ (Communicable Diseases) মোকাবেলায় সাফল্য অর্জিত হলেও, দেশে এখন অসংক্রামক রোগ (NCDs)—যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এবং ক্যান্সার—প্রাধান্য বিস্তার করছে । এই রোগের চিকিৎসায় উন্নত অবকাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের প্রয়োজন। বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (UHC) অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । UHC অর্জনের অগ্রগতি মূলত তিনটি মাত্রায় পরিমাপ করা হয়: স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত, প্রদত্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যাপ্তি এবং আর্থিক সুরক্ষা । প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রগতি সত্ত্বেও, আর্থিক সুরক্ষা এবং গুণগত সেবার অভাবে UHC অর্জনের লক্ষ্য এখনো বহুলাংশে পিছিয়ে রয়েছে    

৩. স্বাস্থ্য খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাসমূহের গভীর বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রকট সংকট তৈরি করেছে স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা, দুর্বল মান এবং শ্রেণী, গোষ্ঠী, অঞ্চল ও লিঙ্গভেদে ব্যাপক বৈষম্য । এই চ্যালেঞ্জগুলো মূলত অর্থায়ন, সুশাসন, এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত।   

৩.১. স্বাস্থ্য অর্থায়ন সংকট এবং বিপর্যয়মূলক ব্যক্তিগত ব্যয়ের বোঝা

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্বল অর্থায়ন এবং সরকারের অগ্রাধিকারের অভাব।

৩.১.১. সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা ও নীতিগত গুরুত্বের অভাব

সরকারি বাজেট বরাদ্দ থেকে দেশে প্রতি বছর স্বাস্থ্য সেবা বাবদ ব্যয়িত মোট অর্থের মাত্র ২৩ শতাংশ নির্বাহ করা হয় । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য সদস্য দেশগুলোকে তাদের জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করার সুপারিশ করে । অথচ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ । গত ১৫ বছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, বরাদ্দের দিক থেকে স্বাস্থ্য খাত এখনো জনপ্রশাসন, শিক্ষা, পরিবহন, প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের পরে ৮ম স্থানে রয়েছে    

৩.১.২. আউট-অফ-পকেট (OOP) ব্যয়ের তীব্রতা

সরকারি বিনিয়োগের এই অপ্রতুলতা সরাসরি নাগরিকদের উপর আর্থিক বোঝা হিসেবে স্থানান্তরিত হয়। বাংলাদেশে নাগরিকদের নিজেদের পকেট থেকেই মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৬৯ শতাংশ) নির্বাহ করতে হচ্ছে । এই উচ্চ মাত্রার OOP ব্যয় প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা কার্যত একটি ব্যক্তিগত পণ্য হিসেবে বাজারে পরিচালিত হচ্ছে, যা সরকারি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা এবং বেসরকারি খাতের বাণিজ্যায়নকে শক্তিশালী করছে। যখন রোগীরা সরকারি কেন্দ্রে বিনামূল্যে ঔষধ বা প্রয়োজনীয় সেবা পান না, তখন তারা বাধ্য হয়ে বেসরকারি খাতে যান, যা OOP ব্যয়কে আকাশচুম্বী করে তোলে।   

এই বিপর্যয়মূলক ব্যয় (Catastrophic Health Expenditure) অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হলে তাকে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় বলা হয় । বাংলাদেশে প্রায় ২৪.৭ শতাংশ পরিবার এই বিপর্যয়মূলক ব্যয়ের মুখে পড়ছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ । তুলনামূলকভাবে, ভারতে এই হার ১৬ শতাংশ এবং নেপালে ১০ শতাংশ । এই উচ্চ ব্যয় বহু মানুষকে দরিদ্র বা নিঃস্ব করে তুলছে এবং অনেকে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকছে, যা UHC অর্জনের মূলনীতি – জনগণের আর্থিক সুরক্ষা – কে সরাসরি লঙ্ঘন করছে।   

টেকসই অর্থায়ন চ্যালেঞ্জের তুলনামূলক চিত্রটি নিম্নরূপ:

Table ১: স্বাস্থ্য অর্থায়ন চ্যালেঞ্জের তুলনামূলক চিত্র

সূচকবাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডদক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থানউৎস
মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি অংশ (%)২৩% (UHC এর জন্য)সর্বনিম্ন হারগুলির মধ্যে একটি
জনগণের নিজস্ব পকেট থেকে ব্যয় (OOP) (%)৬৯% (আদর্শ)দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ
বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের হার (%)২৪.৭% পরিবার (UHC লক্ষ্য)দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বোচ্চ
স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি বরাদ্দ (%)স্বল্প (বিশ্বের সর্বনিম্নগুলির একটি)সর্বনিম্ন
  

৩.২. সুশাসন, দুর্নীতি ও সম্পদের অপচয়

স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের অপ্রতুলতার চেয়েও মারাত্মক সমস্যা হলো দুর্বল সুশাসন এবং সম্পদের চরম অপচয়। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ অপচয় হয়    

৩.২.১. বাজেটে অপচয় ও অদক্ষতা

সরকারি স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব প্রকট। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, কয়েক গুণ বেশি দামে প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে এবং উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় নিজেই অনেক সময় এমন চাহিদা তৈরি করে, যা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর প্রয়োজন নয় । এর ফলস্বরূপ, নতুন কেনা ৪০ শতাংশ চিকিৎসা যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে । উদাহরণস্বরূপ, কভিড-১৯ মহামারীর সময় কিছু সরঞ্জামের দাম ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল    

একটি গভীর বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়ন দক্ষতা কম থাকায় এবং ৩০ শতাংশ অপচয়ের কারণে সরকার স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে আগ্রহী হচ্ছে না, যা এক ধরনের নেতিবাচক চক্র সৃষ্টি করে । উচ্চ রাজনৈতিক প্রভাব নির্মাণ প্রকল্প এবং যন্ত্রপাতি ক্রয়ে লবিং চালায়, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ জনবল নিয়োগ বা প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহের মতো খাতগুলো থেকে সম্পদ সরিয়ে নেওয়া হয়    

৩.২.২. অবকাঠামো নির্মাণ বনাম কার্যকর সেবা

উন্নয়ন বরাদ্দের বড় অংশ অপ্রয়োজনীয় নির্মাণে ব্যয় হয়। বাজেটের ৩০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় নতুন ভবন নির্মাণে, যেখানে বিদ্যমান অবকাঠামোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম । আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, নবনির্মিত হাসপাতালগুলোর প্রায় ৪৫ শতাংশই জনবল ও মৌলিক ইউটিলিটির অভাবে চালু হতে বিলম্ব ঘটে । অর্থাৎ, সরকার অবকাঠামো তৈরি করলেও প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং জনবল নিয়োগের ব্যর্থতার কারণে সেই অবকাঠামো থেকে জনগণ সেবা পাচ্ছে না।   

Table ৩: স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য এবং সুশাসন ঘাটতি

চ্যালেঞ্জ ক্ষেত্রপরিসংখ্যান/প্রমাণতাৎপর্যউৎস
বাজেট অপচয়ের হার~৩০% বার্ষিক অপচয়সম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুতর ঘাটতি
অব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রপাতিনতুন কেনা ৪০%ভুল ক্রয় ও অপ্রয়োজনীয় চাহিদা
গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তার প্রাপ্যতা২৫% কেন্দ্রেসেবার সমতায় তীব্র বৈষম্য
নতুন হাসপাতাল উদ্বোধনে বিলম্ব৪৫% জনবল/ইউটিলিটির অভাবেউন্নয়ন বরাদ্দের অদক্ষতা
স্বাস্থ্যখাতের জাতীয় বাজেট অগ্রাধিকার৮ নম্বরেনীতিনির্ধারণী স্তরে গুরুত্বের অভাব
  

৩.৩. সেবার মান ও সমতার অভাব

স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও মানের মধ্যে তীব্র অসামঞ্জস্য বিদ্যমান, যা শ্রেণী, গোষ্ঠী এবং অঞ্চলভেদে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে    

৩.৩.১. শহর-গ্রাম বৈষম্য ও দুর্বল প্রবেশগম্যতা

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শহর ও গ্রাম অঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য প্রকট। Bangladesh Health Watch-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শহুরে এলাকায় ৬৭% স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার পাওয়া যায়, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় এই হার মাত্র ২৫% । উচ্চ আয়ের জনগণ উন্নত হাসপাতাল ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন, কিন্তু নিম্ন আয়ের জনগণ সাধারণত স্থানীয়, দুর্বল সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উপর নির্ভরশীল থাকে । নারীদের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলিতে বৈষম্য দেখা যায়    

৩.৩.২. দুর্বল রেফারেল পদ্ধতি ও দ্বিতীয় স্তরের অব্যবস্থাপনা

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কাঠামোবদ্ধ রেফারেল পদ্ধতির দুর্বলতা একটি প্রকট সংকট । কমিউনিটি ক্লিনিক (CC) প্রাথমিক পর্যায়ে সফল হলেও, যখন রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা জেলা পর্যায়ে রেফার করা হয়, তখন অব্যবস্থাপনা শুরু হয় । সরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে প্রায়শই জরুরি বিভাগে চিকিৎসক থাকেন না, পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদির অভাব থাকে, অথবা বিদ্যমান সরঞ্জামাদি পরিচর্যার অভাবে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকে । এই দুর্বলতার কারণে রোগী সরাসরি উচ্চ-খরচের তৃতীয় স্তরের বেসরকারি সেবার দিকে ধাবিত হয়, যা রেফারেল ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তোলে এবং ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়িয়ে দেয়    

৩.৩.৩. বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যায়ন

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলির প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। এই বেসরকারি খাতের সেবা উচ্চমানের হলেও, তা অধিকাংশ জনগণের জন্য অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী নয় । বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স দিতে অবৈধ অর্থের লেনদেনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে । এই খাতের নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যায়ন সার্বজনীন সমতা প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা।   

৩.৪. মানবসম্পদ সংকট ও ব্যবস্থাপনা

স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে পর্যাপ্ত ডাক্তার, দক্ষ নার্স, এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা । সরকার ৪৭ হাজারেরও বেশি জনশক্তি নিয়োগের উদ্যোগ নিলেও , মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এই প্রচেষ্টাগুলোকে দুর্বল করে দিচ্ছে।   

৩.৪.১. তৃণমূল কর্মীর অনিশ্চয়তা ও মাইগ্রেশন

কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (CHCP) মডেল প্রাথমিক সেবার ভিত্তি হলেও, CHCP-দের চাকরির স্থায়িত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক CHCP চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, কারণ তাদের চাকরি এখনও কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টে ন্যস্ত করা হয়নি । জনবল ধরে রাখার (Retention) এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে এইচআরএইচ সংকট কেবল নিয়োগের অভাব নয়, বরং পদায়ন, প্রণোদনা এবং কর্মপরিবেশের সাথে সম্পর্কিত।   

৩.৪.২. পদায়ন ও গ্রামীণ এলাকায় ধরে রাখার দুর্বলতা

গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক ও দক্ষ কর্মীদের ধরে রাখার জন্য কার্যকর প্রণোদনা নীতির অভাব রয়েছে। এই কারণে গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তারের উপস্থিতি মাত্র ২৫%। যদিও ১,৪০১ জন মিডওয়াইফ নিয়োগ ও পদায়ন করা হয়েছে , যদি তাদের জন্য গ্রামীণ এলাকায় থাকার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও সামাজিক প্রণোদনা এবং উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না হয়, তবে এই নিয়োগগুলিও ফলপ্রসূ হবে না।   

৪. সমাধানের কৌশলগত রোডম্যাপ: UHC ২০৩২ অর্জনের ভিত্তি

২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য খাতে কাঠামোগত সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। এই রোডম্যাপ চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া উচিত: অর্থায়ন সংস্কার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালীকরণ, সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন।

৪.১. টেকসই অর্থায়ন মডেল প্রবর্তন

৪.১.১. বাজেট অগ্রাধিকার ও কৌশলগত বরাদ্দ

স্বাস্থ্য খাতকে রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের শীর্ষে নিয়ে আসতে হবে। অবিলম্বে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন । সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয় (বর্তমানে ২৩%) বাড়িয়ে অন্তত ৫০% এ উন্নীত করার কৌশল নিতে হবে।   

বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য কৌশলগত ক্রয় (Strategic Purchasing) ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক । বিশেষত, 'নগদ মজুরি ও বেতন' এবং 'মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল সাপ্লাই' খাতে বরাদ্দ তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ানো উচিত । এই বরাদ্দ বাড়ালে অব্যয়িত থাকার সম্ভাবনা কম এবং এটি সরাসরি জনবলের প্রাপ্যতা ও বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ নিশ্চিত করে নাগরিকদের পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমিয়ে আনে    

৪.১.২. জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা (National Health Insurance Scheme) প্রবর্তন

ব্যক্তিগত ব্যয়ের বোঝা কমাতে এবং আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একটি ব্যাপক, বাধ্যতামূলক এবং জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কাঠামো ডিজাইন করা অপরিহার্য । ছোট, খণ্ডিত কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পগুলো অপ্রতুল অর্থ সংগ্রহ এবং সীমিত সেবার আওতার কারণে কার্যকর হয় না। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও দেখায় যে এসব প্রকল্প জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার মধ্যে একীভূত হওয়াই শ্রেয় । কার্যকর অর্থায়ন মডেল তৈরি করাই বাংলাদেশের পরবর্তী লক্ষ্য হওয়া উচিত    

৪.২. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও রেফারেল ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ

৪.২.১. কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলের স্থায়িত্ব ও সক্ষমতা বৃদ্ধি

কমিউনিটি ক্লিনিক (CC) মডেলকে কেবল মৌলিক সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে NCDs মোকাবেলার প্রথম স্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস রোগে সেবনযোগ্য ঔষধের নিয়মিত সরবরাহ এবং স্ক্রিনিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা প্রয়োজন । যেসব সিসি অবকাঠামোগতভাবে নাজুক (বিশেষত ১৯৯৮-২০০১ সময়ে নির্মিত), সেগুলোর জরুরি পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার আবশ্যক । এছাড়াও, স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা দরকার    

৪.২.২. কার্যকর কাঠামোবদ্ধ রেফারেল ব্যবস্থা

কাঠামোবদ্ধ রেফারেল কৌশলগুলোর কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যা সিসি থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (UHC) এবং জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত সুসংগঠিত হওয়া উচিত । এই রেফারেল ব্যবস্থা তখনই সফল হবে, যখন উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোকে পর্যাপ্ত জনবল, মানসম্মত সরঞ্জাম ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পূর্ণ সক্ষমতা প্রদান করা হবে। এটি না হলে রেফারেল ব্যর্থ হয়ে রোগীরা পুনরায় ব্যয়বহুল বেসরকারি সেবার দিকে ঝুঁকবে।   

৪.৩. সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ

৪.৩.১. দুর্নীতি প্রতিরোধ ও স্বচ্ছতা

স্বাস্থ্য খাতে ৩০ শতাংশ বাজেট অপচয় রোধের জন্য ক্রয় এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কঠোর তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষা (Audit) এবং ডিজিটাল ট্র্যাকিং বাধ্যতামূলক করতে হবে । সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নির্মাণ প্রকল্প ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে রাজনৈতিক সুবিধা বিতরণের চক্রকে ভেঙে দিতে হবে    

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স প্রদান এবং তাদের সেবার মান নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা আবশ্যক    

৪.৩.২. নজরদারি ও মূল্যায়ন (Monitoring and Supervision)

মাঠ পর্যায়ে সেবার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য টেকনিক্যাল সুপারভিশনের মাধ্যমে নজরদারি ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে । এর জন্য প্রণীত চেকলিস্ট ব্যবহার করে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ, ফিডব্যাক প্রদান এবং শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সেবার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব। স্বাস্থ্য ডেটা সিস্টেম ব্যবহার করে হেলথ আউটকাম পরিমাপ এবং সমতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিসি সংলগ্ন এলাকার খানাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন    

৪.৪. স্বাস্থ্য মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ধরে রাখা

৪.৪.১. CHCP-দের প্রতিষ্ঠানিকীকরণ

কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে CHCP-দের চাকরি দ্রুত নিয়মিতকরণ করে তাদের নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের চাকরি ছেড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য এটি একটি মৌলিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ    

৪.৪.২. গ্রামীণ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন

গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জনবল (ডাক্তার, নার্স, মিডওয়াইফ) ধরে রাখার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা, অগ্রাধিকারমূলক পদোন্নতি, এবং মানসম্মত আবাসন সুবিধা সংবলিত একটি গ্রামীণ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন করতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তার প্রাপ্যতা (২৫%) এবং শহরে ডাক্তার প্রাপ্যতা (৬৭%) এর মধ্যে বিদ্যমান তীব্র বৈষম্য দূর করতে এই প্রণোদনা নীতি অত্যন্ত জরুরি    

৪.৪.৩. দক্ষতা বৃদ্ধি ও বিশেষজ্ঞতা

চিকিৎসা গবেষণার ওপর নিরন্তর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন । বিশেষত মানসিক স্বাস্থ্য এবং স্নায়বিক রোগের বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত নীতি এবং পদক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে বিশেষজ্ঞ জনবল তৈরি করতে হবে । বিএসএমএমইউ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি    

৫. সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (UHC) অর্জনের পথ (Pathway to UHC 2032)

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার তিনটি মাত্রা—জনসংখ্যা কভারেজ, সেবার ব্যাপ্তি এবং আর্থিক সুরক্ষা—অর্জনের জন্য একটি সমন্বিত কৌশল বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

৫.১. সেবার ব্যাপ্তি সম্প্রসারণ

স্বাস্থ্যসেবার আওতা কেবল সংক্রামক রোগ বা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে অসংক্রামক রোগ (NCDs), মানসিক স্বাস্থ্য, এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবার আওতা তৃণমূল পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা উচিত । ইতোমধ্যে ডেঙ্গু মোকাবেলায় হাই অ্যালার্টে কাজ করা হচ্ছে এবং ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে    

৫.২. তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

সকলের জন্য স্বাস্থ্য আইডি (Health ID) সহ একটি আন্তঃ-চালিত, ডেটা-নির্ভর স্বাস্থ্য তথ্য সিস্টেম তৈরি করা UHC অর্জনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধাপ । এই ডিজিটাল সিস্টেম সেবার সমতা ও প্রবেশগম্যতা ট্র্যাকিংয়ে সহায়ক হবে। টেলিমেডিসিন সেবার মতো উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলো চালু করার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সহজেই পরামর্শ করার সুযোগ পাচ্ছে    

৫.৩. নতুন বৈশ্বিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ডেঙ্গু পরিস্থিতির মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) মোকাবেলার জন্য সরকারকে একটি 'এক স্বাস্থ্য পদ্ধতি' (One Health Approach) প্রচার করতে হবে । এই আন্তঃ-খাত সমন্বয় জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।   

৬. উপসংহার এবং চূড়ান্ত সুপারিশমালা

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত মৌলিক জনস্বাস্থ্য সূচকগুলোতে প্রভূত সাফল্য অর্জন করলেও, এটি এখন একটি গুরুতর কাঠামোগত পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার পর থেকে অর্জিত সাফল্যগুলো বর্তমানে অর্থায়ন, সুশাসন এবং সেবার মানের তীব্র বৈষম্যের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উচ্চ ব্যক্তিগত ব্যয় (৬৯%) এবং বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের (২৪.৭%) হার জনস্বাস্থ্যের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চরম আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।

২০৩২ সালের মধ্যে UHC অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে, সরকারের জন্য নিম্নলিখিত চূড়ান্ত সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হলো:

১. অর্থায়ন বিপ্লব: স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের একটি আইনি ও কৌশলগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা। জনস্বাস্থ্য ব্যয় ২৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৫০ শতাংশে উন্নীত করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা। ২. জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা প্রবর্তন: জনগণের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে খণ্ডিত প্রকল্প বাদ দিয়ে একটি ব্যাপক এবং বাধ্যতামূলক জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা কাঠামো তৈরি ও বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করা। ৩. সুশাসন ও অপচয় রোধ: ক্রয় ও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে কঠোর তৃতীয় পক্ষের নিরীক্ষা ও ডিজিটাল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ৩০ শতাংশ বাজেট অপচয় রোধ করা। নবনির্মিত স্থাপনাগুলিতে ৪৫ শতাংশ বিলম্বের কারণ প্রশাসনিক দুর্বলতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। ৪. মানবসম্পদ স্থিতিশীলতা: গ্রামীণ এলাকায় ডাক্তারদের ধরে রাখার জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ প্রবর্তন এবং CHCP-দের চাকরি দ্রুত নিয়মিতকরণ করে তৃণমূল স্তরের কর্মীদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৫. রেফারেল ব্যবস্থা ও NCD সক্ষমতা: কমিউনিটি ক্লিনিককে NCD স্ক্রিনিং ও প্রাথমিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র হিসেবে শক্তিশালী করা এবং রেফারেল চেইনকে শক্তিশালী করার জন্য উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে জনবল ও সরঞ্জামাদির পূর্ণ সক্ষমতা নিশ্চিত করা।



ourparliament.org
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে
Opens in a new window
prothomalo.com
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় বেশি - প্রথম আলো
Opens in a new window
bangladesh.gov.bd
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা | People's Republic of Bangladesh | গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Opens in a new window
buhn.org
প্রতিবেদন • স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন - Bangladesh Urban Health Network (BUHN)
Opens in a new window
file-rajshahi.portal.gov.bd
স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারের সাফল্য উল্লেখ করার মত। বিভিন্ন আন্তর্জাাতিক সংস্থা যেমন ঃ জাতিসংঘ - RAJSHAHI
Opens in a new window
ittefaq.com.bd
সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর - The Daily Ittefaq
Opens in a new window
cs.naogaon.gov.bd
আমাদের অর্জনসমূহ - সিভিল সার্জন অফিস, নওগাঁ ।
Opens in a new window
documents.worldbank.org
The path to universal health coverage in Bangladesh : bridging the gap of human resources for health (English) - World Bank Documents
Opens in a new window
banglatribune.com
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে স্বাস্থ্যবিমা কি জরুরি? - Bangla Tribune
Opens in a new window
prothomalo.com
দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ - প্রথম আলো
Opens in a new window
kalerkantho.com
দুর্নীতি-অনিয়মে স্বাস্থ্য খাতের বাজেটের ৩০% অপচয় - কালের কণ্ঠ
Opens in a new window
doctortv.net
স্বাস্থ্যসেবা ভোগে বৈষম্য: বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পার্থক্য - Doctor TV
Opens in a new window
communityclinic.portal.gov.bd
ইতিহাস-ও-কার্যাবলী - কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাষ্ট
Opens in a new window
bangla.bdnews24.com
বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা সেবা: একটি নাগরিক পর্যালোচনা - bdnews24.com
Opens in a new window
hsd.portal.gov.bd
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ - প্রশাসন-৪ (মনিটরিং ও সমন্বয়) অধিশাখা - বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা। www.hsd.gov.bd - Untitled
Opens in a new window
amadershomoy.com
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নতুন স্বাস্থ্য নেতা, আর আমাদের প্রত্যাশা - Amader Sho

Post a Comment

0 Comments