ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বাংলাদেশের শিক্ষা খাত: কৌশলগত দুর্বলতা, গুণগত মান সংকট এবং নীতিগত সুপারিশমালা

 

বাংলাদেশের শিক্ষা খাত: কৌশলগত দুর্বলতা, গুণগত মান সংকট এবং নীতিগত সুপারিশমালা

বাংলাদেশের শিক্ষা খাত: কৌশলগত দুর্বলতা, গুণগত মান সংকট এবং নীতিগত সুপারিশমালা

অংশ ১: কার্যনির্বাহী সারসংক্ষেপ এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ

১.১. ভূমিকা এবং প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য

জাতি গঠনের অপরিহার্য ভিত্তি হলো শিক্ষা, এবং বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (Growth Trajectory) ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। সরকার ২০০৯ সাল থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে, যার মূল ভিত্তি হলো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১ । এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের বর্তমান সাফল্যগুলো এবং একই সাথে এর কাঠামোগত ও গুণগত দুর্বলতাগুলোর একটি ভারসাম্যপূর্ণ পর্যালোচনা উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনের মূল লক্ষ্য হলো বিদ্যমান সমস্যাগুলোর বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ (SDG 4) অর্জনের জন্য প্রমাণভিত্তিক ও কৌশলগত নীতিগত সুপারিশমালা প্রণয়ন করা।   

১.২. বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের উল্লেখযোগ্য অর্জন (Access and Equity Successes)

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে পরিমাণগত সাফল্য (Quantitative Success) ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। শিক্ষার্থী ভর্তির হার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেয়েছে । ২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ৬১ শতাংশেরও বেশি ছিল, যা কমে বর্তমানে ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অনুরূপভাবে, উচ্চ শিক্ষাস্তরে ঝরে পড়ার হার ২০০৮ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে কমে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ হয়েছে    

বিশেষত, জেন্ডার সমতা অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের অংশগ্রহণের হার এখন দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। যেখানে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ৪৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৫১ শতাংশই ছাত্রী । এই সাফল্য অর্জনের পেছনে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট (PMEAT) এর মাধ্যমে পরিচালিত উপবৃত্তি কর্মসূচির সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এই ট্রাস্ট ২০১০ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত হয়েছিল এবং ২০১২ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে, যার উদ্দেশ্য দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিত করা, জেন্ডার সমতা অর্জন এবং প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণে উৎসাহ প্রদান করা । PMEAT স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এবং ভর্তি সহায়তা প্রদান করছে    

১.৩. শিক্ষার সার্বিক চিত্রের পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা (Statistical Overview)

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশক্তি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে । এটি শিক্ষার প্রসারে একটি ইতিবাচক চিত্র। তবে, কিছু পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা এখনও প্রকট। যদিও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ঝরে পড়ার হার কমেছে, প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার এই হার এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে    

সবচেয়ে বড় কৌশলগত দুর্বলতা দেখা যায় দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বিবিএসের জরিপ অনুসারে, দেশের কর্মক্ষম শিক্ষিত জনগণের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ গত এক বছরে কোনো ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে । এই পরিসংখ্যানটি দেশের বিপুল কর্মক্ষম যুব জনশক্তির দক্ষতার ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে একটি বড় বাধা নির্দেশ করে।   

১.৪. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)

শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য বিশ্লেষণ করলে একটি দ্বান্দ্বিক চিত্র (Quantity-Quality Paradox) সামনে আসে। একদিকে ব্যাপক ভর্তির হার বৃদ্ধি এবং জেন্ডার সমতার মতো পরিমাণগত লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে অর্জিত হয়েছে , যা সরকারের শিক্ষাকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকারের প্রতিফলন। অন্যদিকে, শিক্ষায় বিশ্বব্যাপী সর্বনিম্ন বিনিয়োগ এবং ফলপ্রসূ পাঠ্যক্রমের অভাবে গুণগত মানের চরম অবনতি হয়েছে। এই অবস্থায়, শিক্ষার্থীরা শুধু একটি সার্টিফিকেট অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করছে, যা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে 'সার্টিফিকেট নির্ভর, দক্ষতাহীন শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানায়' পরিণত করেছে    

এই দ্বৈত অবস্থা নীতি-নির্ধারকদের জন্য একটি গভীর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে—কীভাবে সীমিত আর্থিক সক্ষমতার মধ্যে শিক্ষণের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া যায়। শিক্ষার মূল সংকট এখন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বদলে প্রকৃত 'শিখন' নিশ্চিত করার ওপর নিবদ্ধ। প্রাথমিক স্তরে গুণগত মানের এই দুর্বলতা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকে প্রভাবিত করছে, কারণ প্রাথমিক শিক্ষা ভালো না হলে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা স্তরে এসে সুবিধা করতে পারে না    

অংশ ২: কাঠামোগত এবং আর্থিক দুর্বলতা (Structural and Financial Vulnerabilities)

২.১. শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ সংকট: বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ (The Funding Crisis)

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার মূল কারণ। বিশ্বব্যাংকের ১৮৯টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ জিডিপি'র অনুপাতে শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দে সর্বনি¤œ ১০টি দেশের একটি । দক্ষিণ এশিয়ায় ২২ বছর ধরে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন অবস্থান বজায় রেখেছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের। ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী, একটি জাতির জিডিপির কমপক্ষে ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করা উচিত।   

অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে: ভুটান তাদের জিডিপি'র প্রায় ৭ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করে; ভারত ৪.৪ শতাংশ এবং এমনকি পাকিস্তানও ২.৩৮ শতাংশ ব্যয় করে বাংলাদেশের তুলনায় উচ্চতর অবস্থানে আছে । শিক্ষা খাতে এই ক্রমাগত নিম্নমুখী প্রবণতা এবং সাম্প্রতিক বাজেটে (২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রেক্ষাপটে) মাত্র ৯৩৪ কোটি টাকার নামমাত্র বৃদ্ধি দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং বিপুল জনসংখ্যার প্রয়োজনের তুলনায় স্থবিরতা নির্দেশ করে। এই আর্থিক স্থবিরতা দেশের জন্য একটি কৌশলগত ব্যর্থতা, যা দেশের জাতীয় অগ্রাধিকারের অভাব, দুর্বল রাজস্ব আহরণ এবং নীতিগত সংকটের প্রতিফলন । এই সর্বনিম্ন বিনিয়োগ মানব পুঁজি নির্মাণে অর্থায়নের ঘাটতি নির্দেশ করে, যা দেশকে দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করতে পারে।   

সারণী ১: দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষায় জিডিপির শতাংশ বরাদ্দ তুলনা

দেশশিক্ষায় জিডিপি বরাদ্দ (%)নীতিগত প্রয়োজনীয়তাউৎস
ভুটান~৭.০%ইউনেসকো সুপারিশ: ৪-৬%
ভারত৪.৪%-
পাকিস্তান২.৩৮%-
বাংলাদেশসর্বনি¤œ ১০টি দেশের একটি (২.৩% এর নিচে, প্রবণতা নিম্নমুখী)-
  

২.২. দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং অর্থায়নের অদক্ষতা (Administrative Weakness and Inefficiency)

যদিও বরাদ্দ সংকট একটি প্রধান সমস্যা, বিদ্যমান সীমিত অর্থের সঠিক ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনার অভাবও লক্ষণীয়। সঠিক নীতি প্রণয়ন এবং অর্থ বিতরণের জন্য নির্ভুল পরিসংখ্যান অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) রিপোর্ট প্রকাশের সময়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল । পরিসংখ্যানের এই ধরনের বিভ্রান্তি সম্পদের কার্যকর ব্যবহার এবং সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অদক্ষতার ইঙ্গিত দেয়।   

২.৩. নীতি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব (Policy Implementation Gap)

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ (NEP 2010) অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত (২০১৮ সালের মধ্যে) সম্প্রসারণের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ছিল । একই সাথে, বিভিন্ন ধারার (সরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, ইবতেদায়ী মাদরাসা) মধ্যে অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে বৈষম্যহীন মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল । এই নীতিগুলোর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে অর্থায়ন সংকট এবং অবকাঠামোগত আবশ্যকতা মেটানো ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করেছে । নীতির সফলতা কেবল তার প্রণয়নের উপর নির্ভর করে না, বরং তার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে।   

২.৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রকট বৈষম্য (Equity Divide)

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রামীণ ও শহরের প্রাথমিক শিক্ষার মানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিরাজমান । বিবিএস রিপোর্ট অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে সাক্ষরতার হার ৮৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা গ্রামীণ অঞ্চলের ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি । এই বৈষম্যের মূল কারণ হলো অবকাঠামোগত ঘাটতি। গ্রামীণ অঞ্চলের অনেক স্কুলে ভাঙা ক্লাসরুম, টয়লেট, নিরাপদ পানীয় জলের অভাব এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের ঘাটতি রয়েছে    

উদাহরণস্বরূপ, দোয়ারাবাজার উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ না থাকায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে; এমনকি বিজ্ঞান বিভাগে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় ব্যবহারিক ক্লাস যথাযথভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না । NEP 2010 এ বিভিন্ন ধারার বিদ্যালয়গুলির মধ্যে সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য দূর করার কথা বলা হলেও, এই বৈষম্য এখনও প্রকট, যা মানসম্মত শিক্ষাকে সকলের জন্য সমানভাবে সহজলভ্য হতে বাধা দিচ্ছে    

২.৫. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)

শিক্ষায় জিডিপি'র অনুপাতে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ একটি স্পষ্ট সংকেত দেয় যে সরকার ভবিষ্যতের মানব পুঁজি নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করছে না। যদিও স্বল্প মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য অপরিহার্য উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিকের জোগান এই আর্থিক স্থবিরতার কারণে কমে যাবে। ফলস্বরূপ, বর্তমান বাজেট নীতি শিক্ষা খাতকে একটি 'দীর্ঘ সুড়ঙ্গে' আটকে রেখেছে, যেখানে গুণগত মানের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না । এটি দেশের টেকসই উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি কৌশলগত দুর্বলতা।   

অন্যদিকে, NEP 2010 এর মতো উচ্চাভিলাষী নীতির বাস্তবায়নে (যেমন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা) অর্থায়ন সংকট এবং অবকাঠামোগত ঘাটতি মূল বাধা সৃষ্টি করেছে। পর্যাপ্ত ভৌত সুবিধা এবং শিক্ষকের ব্যবস্থা না করে শুধু মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করলে শিক্ষার মান আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নীতিগত সাফল্য অর্জনের জন্য নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি তার বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার অপরিহার্য।   

অংশ ৩: গুণগত মান এবং মানবসম্পদ সংকট (Quality and Human Resource Crisis)

৩.১. শিক্ষক সঙ্কট: মান, মর্যাদা ও প্রশিক্ষণ (The Teacher Crisis)

মানসম্মত শিক্ষাদানের মূল হাতিয়ার হলেন শিক্ষক, কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশার সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক প্রণোদনা অত্যন্ত দুর্বল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বর্তমান বেতন স্কেলকে 'পুরাপুরি অপমানজনক' এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতনের সমতুল্য বলে সমালোচনা করা হয়েছে । এই নিম্ন বেতন মেধাবী তরুণদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে।  

পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি শিক্ষা কার্যক্রমের পরিবেশ নষ্ট করছে; একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ ও শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চা হওয়া উচিত, তবে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বন্ধ করা প্রয়োজন । এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংখ্যা কম এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বেশি হওয়ায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে । মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য শিক্ষকদের নিবিড় পেশাগত উন্নয়ন (CPD) এবং প্রস্তুতির অভাব পরিলক্ষিত হয়    

৩.২. পাঠ্যক্রমের অকার্যকরতা এবং শিখন সংকট (Curriculum Ineffectiveness and Learning Crisis)

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার অভাবের কারণে কেবল সার্টিফিকেট নির্ভর হয়ে পড়েছে । এর ফলে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জন করলেও কর্মজীবনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রাথমিক স্তরে মৌলিক ভিত্তি দুর্বলতা। বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আনুমানিক পাঁচ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী মৌলিক সাক্ষরতা এবং সংখ্যা জ্ঞান (Basic Literacy and Numeracy) অর্জন করতে পারেনি, অর্থাৎ তারা মৌলিক পাঠ্যটি পড়ার ও বোঝার ক্ষমতা এবং প্রাথমিক গাণিতিক প্রক্রিয়া সম্পাদনে দুর্বল    

এই ফাউন্ডেশনাল লার্নিং ক্রাইসিস নির্দেশ করে যে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে এবং ৪র্থ ও ৫ম শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে নতুন, প্রায়োগিক এবং দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

৩.৩. দুর্বল অবকাঠামো এবং ডিজিটাল বিভাজন (Infrastructure and Digital Divide)

গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ চালু থাকলেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় ব্যবহারিক ক্লাসগুলো যথাযথভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। ডিজিটাল যুগেও কিছু শিক্ষার্থী কম্পিউটার সম্পর্কে কোনো ধারণা পাচ্ছে না    

যদিও প্রযুক্তির সংযোজন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো (যেমন: টেন মিনিট স্কুল, খান একাডেমি) জনপ্রিয়তা লাভ করছে , গ্রামীণ-শহুরে অবকাঠামোগত বৈষম্য ডিজিটাল সমতা অর্জনে বাধা দিচ্ছে। শহরাঞ্চলে সুসজ্জিত ভবন ও ডিজিটাল সুবিধা পাওয়া গেলেও , উচ্চ সেটআপ ব্যয়বহুল 'স্মার্ট ক্লাসরুম'-এর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহনের ক্ষমতা সব প্রতিষ্ঠানের নেই । ফলে ডিজিটাল সুবিধার সুবিধা শহরাঞ্চলে বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মাধ্যমে ক্লাউড-ভিত্তিক কন্টেন্ট ব্যবহারের সুযোগ বাড়লেও, গ্রামীণ অবকাঠামোগত ঘাটতি এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।   

৩.৪. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)

শিক্ষকদের নিম্ন বেতন ও সামাজিক মর্যাদা তাদেরকে অর্থনৈতিক সুবিধা এবং ক্ষমতার জন্য দলীয় রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়। এই রাজনৈতিকীকরণ শিক্ষার পেশাগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং নিরপেক্ষ শিক্ষা পরিবেশ ব্যাহত করে। শিক্ষকদের পেশাগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে সম্মানজনক বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা হলে পেশার প্রতি আকর্ষণ বাড়বে এবং শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতিমুক্ত পেশাদারিত্ব ফিরে আসবে    

অন্যদিকে, প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানের অভাব নির্দেশ করে যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। এটি মূলত শিক্ষক মানের ঘাটতি এবং পাঠ্যক্রমের অকার্যকরতার প্রত্যক্ষ ফল। যখন প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি দুর্বল থাকে, তখন শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা স্তরে এসে প্রতিযোগিতা করতে পারে না । এই দুর্বলতা উচ্চ শিক্ষায় গুণগত মানের অবনতি ঘটিয়ে সার্টিফিকেট-নির্ভর বেকারত্ব বাড়িয়ে তোলে । তাই এই সমস্যার সমাধানে অবশ্যই প্রারম্ভিক শৈশবকালীন যত্ন ও শিক্ষা (ECCE) থেকে শুরু করে মৌলিক ভিত্তি মজবুত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে    

অংশ ৪: কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (TVET) এবং কর্মসংস্থানমুখী চ্যালেঞ্জ

৪.১. যুব জনশক্তি এবং কর্মসংস্থানের চাপ (Youth Demographics and Employment Pressure)

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) যুব জনশক্তি। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে । এই বিপুল তরুণ জনশক্তি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সহায়ক। তবে ক্রমবর্ধমান এই শ্রমশক্তির জন্য উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ । এই জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে দক্ষতা প্রদান করে কর্মক্ষম করা অত্যন্ত জরুরি।   

৪.২. টিভিইটি (TVET) ব্যবস্থার দুর্বলতা (Weaknesses of the TVET System)

কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (TVET) কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়লেও, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। TVET প্রোগ্রামের গ্রাজুয়েটগণ প্রায়শই তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করলেও শিল্প খাতে চাহিদাসম্পন্ন ব্যবহারিক দক্ষতা প্রদর্শনে মারাত্মকভাবে দুর্বল থাকেন । এই অসামঞ্জস্যতা বেকারত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা যুবকদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নষ্ট করছে এবং জাতীয় উৎপাদনশীলতাকেও সীমিত করে ফেলছে    

এছাড়াও, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, চাকরির সুযোগ এবং শোভন কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও কারিগরি শিক্ষার তাৎপর্য ব্যাপকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি, ফলে তরুণদের বড় অংশের অংশগ্রহণ এখনও অপেক্ষাকৃত কম    

৪.৩. কারিগরি শিক্ষার সামাজিক মর্যাদা ও ভ্রান্ত ধারণা (Low Social Stigma)

কারিগরি শিক্ষার সামাজিক মর্যাদা নেই এবং সাধারণভাবে এটি একটি নেতিবাচক মানসিকতা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে । এটি TVET খাতে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর পথে একটি বড় অন্তরায়। বিশেষ করে নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং সুবিধাবঞ্চিত অন্যান্য শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত দুর্বল । যদিও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১ অনুমোদনের মাধ্যমে সরকার একটি বাজার-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রগতি অর্জন করেছে , তৃণমূল পর্যায়ে এই সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন এখনও সম্ভব হয়নি।   

৪.৪. নীতিগত অগ্রগতি: দ্বৈত সনদায়ন ব্যবস্থার গুরুত্ব (The Dual Certification Initiative)

টিভিইটি ব্যবস্থার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড TVET প্রোগ্রামে 'দ্বৈত সনদায়ন' (Dual Certification) ব্যবস্থা চালু করতে কাজ করছে, যা NTVQF/BNQF কাঠামোর সাথে সমন্বয়যুক্ত । এই পদ্ধতি শ্রেণিকক্ষের তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি নির্দিষ্ট পেশাগত প্রশিক্ষণকে সংশ্লিষ্ট করে, ফলে শিক্ষার্থীরা সেক্টরভিত্তিক একাডেমিক যোগ্যতা সনদের পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতার সনদও অর্জন করার সুযোগ পায় । এটি শিল্প খাতের প্রয়োজনীয়তা পূরণে সহায়ক এবং গ্রাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বাড়াতে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করে।   

৪.৫. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)

বাংলাদেশের বিপুল যুব জনশক্তি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু যদি এই জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতা দেওয়া না যায় এবং TVET ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের কর্মক্ষম করা না হয়, তাহলে এই 'যুব লভ্যাংশ' (Demographic Dividend) দ্রুতই 'যুব বোঝায়' (Demographic Burden) পরিণত হবে। দক্ষতা-চাহিদার মধ্যে ফারাক দূর না হলে, দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নষ্ট হবে এবং জাতীয় উৎপাদনশীলতা সীমিত হয়ে পড়বে    

এই প্রেক্ষাপটে, TVET-তে দ্বৈত সনদায়ন কার্যকর করা একটি কৌশলগত সমাধান। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে TVET গ্রাজুয়েটদের ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, এবং এর ফলে তাদের কর্মসংস্থান বাড়বে। যখন কর্মসংস্থান বাড়বে, তখন কারিগরি শিক্ষার সামাজিক মর্যাদা এবং নেতিবাচক ধারণা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হবে । এটি বেকারত্ব হ্রাস এবং সামাজিক ধারণা পরিবর্তনের মধ্যে বিদ্যমান নেতিবাচক চক্র ভাঙার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।   

অংশ ৫: কৌশলগত ও বহুমাত্রিক সমাধান (Strategic and Multi-Layered Solutions)

কাঠামোগত এবং গুণগত সংকট মোকাবেলায় নিম্নলিখিত কৌশলগত ও নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

৫.১. আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুশাসন (Financial Strengthening and Governance)

ক. বরাদ্দ বৃদ্ধি: শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ও ইউনেসকো সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষায় জিডিপি'র কমপক্ষে ৪ শতাংশ ব্যয় করার জন্য সরকারকে দ্রুত একটি সুস্পষ্ট সময়ভিত্তিক রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে । শিক্ষা খাতকে জাতীয় অগ্রাধিকারের শীর্ষে নিয়ে আসা আবশ্যক।   

খ. অর্থায়নের স্বচ্ছতা: বাজেট বরাদ্দের কার্যকারিতা বাড়াতে প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার, দুর্নীতি দমন এবং শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (BANBEIS) এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সঠিক ও নির্ভুল পরিসংখ্যান নিশ্চিত করা    

৫.২. শিক্ষক উন্নয়ন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি (Teacher Development and Professionalization)

ক. বেতন স্কেল পুনর্বিন্যাস ও মর্যাদা: শিক্ষকদের বেতন স্কেলকে 'তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মতো' অবস্থা থেকে উন্নত করে পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি করা। শিক্ষক নিয়োগে কঠোর মানদণ্ড নির্ধারণ এবং মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ বৃত্তি বা প্রণোদনা প্রদান করা উচিত।   

খ. নিবিড় পেশাগত প্রশিক্ষণ (CPD): শিক্ষকদের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম, ডিজিটাল শিক্ষণ পদ্ধতি এবং ফলপ্রসূ শিখন-শেখানো কার্যক্রমের উপর নিয়মিত ও নিবিড় পেশাগত প্রশিক্ষণ (CPD) নিশ্চিত করা    

গ. রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এর পরিবর্তে শিক্ষক সমিতি এবং ছাত্র সংসদের মাধ্যমে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক চর্চা ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করা যেতে পারে    

৫.৩. পাঠ্যক্রম সংস্কার এবং দক্ষতা উন্নয়ন (Curriculum Reform and Skill Development)

ক. ফাউন্ডেশনাল শিক্ষা মজবুতকরণ: মৌলিক শিখন সংকটের মোকাবিলায় ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যা জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তার জন্য একটি জরুরি জাতীয় মিশন চালু করা আবশ্যক । প্রারম্ভিক শৈশব যত্ন ও শিক্ষা (ECCE) থেকে শুরু করে শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে    

খ. দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলাম: সার্টিফিকেট-সর্বস্বতা কাটিয়ে উঠতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং প্রায়োগিক ও দক্ষতাভিত্তিক শিখন (Competency-Based Learning) নিশ্চিত করা, যা কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয়।   

গ. দ্বৈত সনদায়ন (Dual Certification): TVET প্রোগ্রামে NTVQF/BNQF এর সাথে এলাইন করে দ্বৈত সনদায়ন ব্যবস্থার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা, যাতে গ্রাজুয়েটরা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দক্ষতার জন্য স্বীকৃতি পায় । এই উদ্যোগ যুব জনশক্তির ঝুঁকি কমাতে এবং শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণ করতে সহায়ক হবে।   

৫.৪. ডিজিটাল সমতা ও অবকাঠামো উন্নয়ন (Digital Equity and Infrastructure Development)

ক. গ্রামীণ অবকাঠামো: গ্রামীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ, পরিষ্কার শৌচাগার, নিরাপদ পানি এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রসহ অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করা । বিজ্ঞান শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা জরুরি।   

খ. প্রযুক্তির ব্যবহার: উচ্চ সেটআপ ব্যয়বহুল 'স্মার্ট ক্লাসরুম'-এর পরিবর্তে ক্লাউড-ভিত্তিক কন্টেন্ট (যেমন: খান একাডেমি, টেন মিনিট স্কুল) ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সুবিধা প্রান্তিক অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া । সুলভ মূল্যে ইন্টারনেটের উচ্চ ব্যান্ডউইথ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এটি সহজসাধ্য।   

গ. শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের ডিজিটাল শিক্ষণ পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টর ব্যবহার এবং এডুটেক প্ল্যাটফর্ম পরিচালনায় দক্ষ করে তুলতে হবে    

৫.৫. ঝরে পড়া রোধ ও সামাজিক সুরক্ষা (Dropout Prevention and Social Safety Net)

ক. উপবৃত্তি কর্মসূচির সম্প্রসারণ: প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত উপবৃত্তি কর্মসূচির পরিধি বৃদ্ধি এবং অর্থ বিতরণে ডিজিটাল স্বচ্ছতা (ই-স্টাইপেন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে) নিশ্চিত করা    

খ. প্রাথমিক স্তরে মনোযোগ: প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার এখনও উদ্বেগজনক হওয়ায় এই স্তরের দুর্বলতা চিহ্নিত করে সামাজিক সুরক্ষাকে আরও কার্যকর করতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা।   

অংশ ৬: উপসংহার এবং ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা (Conclusion and Future Action Plan)

৬.১. প্রধান সুপারিশগুলোর সংক্ষিপ্ত পুনরুল্লেখ

বাংলাদেশের শিক্ষা খাত পরিমাণগতভাবে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং গুণগত মানের সংকট এটিকে কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়নের পথে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। প্রধান কৌশলগত সুপারিশগুলো হলো: ১. শিক্ষা খাতে বিনিয়োগে জিডিপি’র ৪% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন; ২. শিক্ষক মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা; ৩. TVET-কে কর্মসংস্থানমুখী করতে দ্বৈত সনদায়ন ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা; এবং ৪. প্রাথমিক স্তরে মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানের উপর জরুরি জাতীয় মনোযোগ প্রদান করা।

৬.২. বাংলাদেশের জন্য ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে শিক্ষার ভূমিকা (The Roadmap to SDG 4)

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ (SDG 4) পূরণের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রবেশাধিকার (Access) নিশ্চিত করার মডেল থেকে সরে এসে গুণগত মান এবং সমতার (Quality and Equity) উপর জোর দিতে হবে। শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার মানের ১০ শতাংশ পার্থক্য এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে মাত্র ১.৪৬ শতাংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে মানসম্পন্ন মানব পুঁজি উন্নয়নে এখনও ব্যাপক পথ পাড়ি দিতে হবে। শিক্ষা খাতকে শুধুমাত্র সামাজিক ব্যয় হিসেবে না দেখে, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল কৌশলগত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা অপরিহার্য। এই বহুমাত্রিক সমস্যা সমাধানে সরকার, বেসরকারি খাত এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বিত, কার্যকর এবং সম্পদ-সমর্থিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।   

সারণী ২: বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের মূল সূচক এবং বৈষম্য

সূচকসাম্প্রতিক তথ্য (বিবিএস/ব্যানবেইস)শহুরে-গ্রামীণ বৈষম্যনীতিগত তাৎপর্য
সাক্ষরতার হার (১৫+ বছর)

৭৭.৭%    

শহর ৮৪.৮%, গ্রাম ৭৪.৬%    

শিক্ষার মানের আঞ্চলিক বৈষম্য জাতীয় মানব পুঁজির ব্যবহারকে সীমিত করছে।
মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার

৪০.২৯% (২০১৫)    

প্রযোজ্য নয়ভর্তির হার বাড়লেও, গুণগত মান নিশ্চিত না হওয়ায় এবং অর্থনৈতিক কারণে ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক।
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ

১.৪৬% (গত ১২ মাসে)    

প্রযোজ্য নয়দক্ষতার ঘাটতি পূরণে TVET-এর ব্যাপক অপ্রতুলতা।
ছাত্রীদের অংশগ্রহণ (মাধ্যমিক)

~৫১%    

প্রযোজ্য নয়উপবৃত্তি ও সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে অর্জিত উল্লেখযোগ্য জেন্ডার সমতা।
shed.gov.bd
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ - মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ
Opens in a new window
shed.gov.bd
জাতীয়-শিক্ষানীতি-২০১০ - মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ
Opens in a new window
techedu.gov.bd
জাতীয়-শিক্ষানীতি-২০১০ - কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর
Opens in a new window
ilo.org
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ - International Labour Organization
Opens in a new window
file-dhaka.portal.gov.bd
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রোগ্রামে দ্বৈত সনদায়ন নির্দেশিকা - DHAKA
Opens in a new window
dailyjanakantha.com
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমছে - Daily Janakantha
Opens in a new window
pmeat.gov.bd
উপবৃত্তি-কার্যক্রম - প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট
Opens in a new window
pmeat.portal.gov.bd
উপবৃত্তি ও বিবিধ আর্থিক সহায়তা সংক্রান্ত হেল্পলাইন - প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট
Opens in a new window
pmeat.gov.bd
উপবৃত্তি-সংক্রান্ত-নোটিশ-বিজ্ঞপ্তি - প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট
Opens in a new window
teachers.gov.bd
দেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার কত? - শিক্ষক বাতায়ন
Opens in a new window
dailyinqilab.com
শিক্ষা খাত কেন উপেক্ষিত? - দৈনিক ইনকিলাব
Opens in a new window
deltatimes24.com
বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা: দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার অভাব ও চ্যালেঞ্জ - Delta Times
Opens in a new window
bn.quora.com
বাংলাদেশ বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার কি হাল? - Quora
Opens in a new window
file-chittagong.portal.gov.bd
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ - CHITTAGONG
Opens in a new window
teachers.gov.bd
গ্রামীণ ও শহরের প্রাথমিক শিক্ষার তুলনা: চ্যালেঞ্জ, কারণ ও সমাধান - শিক্ষক বাতায়ন
Opens in a new window
sunamkantha.com
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নিন
Opens in a new window
education.gov.in
জাতীয় শিক্ষা নীতি 2020
Opens in a new window
teachers.gov.bd
ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ - শিক্ষক বাতায়ন
Opens in a new window
dte.bangladesh.za.net
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা জনপ্রিয় করতে প্রচার কর্মসূচি কৌশলপত্র
Opens in a new window

Post a Comment

0 Comments