বাংলাদেশের শিক্ষা খাত: কৌশলগত দুর্বলতা, গুণগত মান সংকট এবং নীতিগত সুপারিশমালা
অংশ ১: কার্যনির্বাহী সারসংক্ষেপ এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ
১.১. ভূমিকা এবং প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য
জাতি গঠনের অপরিহার্য ভিত্তি হলো শিক্ষা, এবং বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (Growth Trajectory) ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরির কোনো বিকল্প নেই। সরকার ২০০৯ সাল থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে, যার মূল ভিত্তি হলো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ 
১.২. বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের উল্লেখযোগ্য অর্জন (Access and Equity Successes)
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে পরিমাণগত সাফল্য (Quantitative Success) ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। শিক্ষার্থী ভর্তির হার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেয়েছে 
বিশেষত, জেন্ডার সমতা অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের অংশগ্রহণের হার এখন দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। যেখানে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ৪৭ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৫১ শতাংশই ছাত্রী 
১.৩. শিক্ষার সার্বিক চিত্রের পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা (Statistical Overview)
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশক্তি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে 
সবচেয়ে বড় কৌশলগত দুর্বলতা দেখা যায় দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বিবিএসের জরিপ অনুসারে, দেশের কর্মক্ষম শিক্ষিত জনগণের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ গত এক বছরে কোনো ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছে 
১.৪. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)
শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য বিশ্লেষণ করলে একটি দ্বান্দ্বিক চিত্র (Quantity-Quality Paradox) সামনে আসে। একদিকে ব্যাপক ভর্তির হার বৃদ্ধি এবং জেন্ডার সমতার মতো পরিমাণগত লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে অর্জিত হয়েছে 
এই দ্বৈত অবস্থা নীতি-নির্ধারকদের জন্য একটি গভীর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে—কীভাবে সীমিত আর্থিক সক্ষমতার মধ্যে শিক্ষণের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া যায়। শিক্ষার মূল সংকট এখন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার বদলে প্রকৃত 'শিখন' নিশ্চিত করার ওপর নিবদ্ধ। প্রাথমিক স্তরে গুণগত মানের এই দুর্বলতা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকে প্রভাবিত করছে, কারণ প্রাথমিক শিক্ষা ভালো না হলে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা স্তরে এসে সুবিধা করতে পারে না 
অংশ ২: কাঠামোগত এবং আর্থিক দুর্বলতা (Structural and Financial Vulnerabilities)
২.১. শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ সংকট: বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ (The Funding Crisis)
শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার মূল কারণ। বিশ্বব্যাংকের ১৮৯টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ জিডিপি'র অনুপাতে শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দে সর্বনি¤œ ১০টি দেশের একটি 
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে: ভুটান তাদের জিডিপি'র প্রায় ৭ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করে; ভারত ৪.৪ শতাংশ এবং এমনকি পাকিস্তানও ২.৩৮ শতাংশ ব্যয় করে বাংলাদেশের তুলনায় উচ্চতর অবস্থানে আছে 
সারণী ১: দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষায় জিডিপির শতাংশ বরাদ্দ তুলনা
| দেশ | শিক্ষায় জিডিপি বরাদ্দ (%) | নীতিগত প্রয়োজনীয়তা | উৎস | 
| ভুটান | ~৭.০% | ইউনেসকো সুপারিশ: ৪-৬% | |
| ভারত | ৪.৪% | - | |
| পাকিস্তান | ২.৩৮% | - | |
| বাংলাদেশ | সর্বনি¤œ ১০টি দেশের একটি (২.৩% এর নিচে, প্রবণতা নিম্নমুখী) | - | 
২.২. দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং অর্থায়নের অদক্ষতা (Administrative Weakness and Inefficiency)
যদিও বরাদ্দ সংকট একটি প্রধান সমস্যা, বিদ্যমান সীমিত অর্থের সঠিক ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনার অভাবও লক্ষণীয়। সঠিক নীতি প্রণয়ন এবং অর্থ বিতরণের জন্য নির্ভুল পরিসংখ্যান অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) রিপোর্ট প্রকাশের সময়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল 
২.৩. নীতি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের অভাব (Policy Implementation Gap)
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ (NEP 2010) অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত (২০১৮ সালের মধ্যে) সম্প্রসারণের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ছিল 
২.৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রকট বৈষম্য (Equity Divide)
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রামীণ ও শহরের প্রাথমিক শিক্ষার মানের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিরাজমান 
উদাহরণস্বরূপ, দোয়ারাবাজার উপজেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষ না থাকায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে; এমনকি বিজ্ঞান বিভাগে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় ব্যবহারিক ক্লাস যথাযথভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না 
২.৫. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)
শিক্ষায় জিডিপি'র অনুপাতে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ 
অন্যদিকে, NEP 2010 এর মতো উচ্চাভিলাষী নীতির বাস্তবায়নে (যেমন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা) অর্থায়ন সংকট এবং অবকাঠামোগত ঘাটতি 
অংশ ৩: গুণগত মান এবং মানবসম্পদ সংকট (Quality and Human Resource Crisis)
৩.১. শিক্ষক সঙ্কট: মান, মর্যাদা ও প্রশিক্ষণ (The Teacher Crisis)
মানসম্মত শিক্ষাদানের মূল হাতিয়ার হলেন শিক্ষক, কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশার সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক প্রণোদনা অত্যন্ত দুর্বল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বর্তমান বেতন স্কেলকে 'পুরাপুরি অপমানজনক' এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতনের সমতুল্য বলে সমালোচনা করা হয়েছে 
পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি শিক্ষা কার্যক্রমের পরিবেশ নষ্ট করছে; একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ ও শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চা হওয়া উচিত, তবে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বন্ধ করা প্রয়োজন 
৩.২. পাঠ্যক্রমের অকার্যকরতা এবং শিখন সংকট (Curriculum Ineffectiveness and Learning Crisis)
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার অভাবের কারণে কেবল সার্টিফিকেট নির্ভর হয়ে পড়েছে 
এই ফাউন্ডেশনাল লার্নিং ক্রাইসিস নির্দেশ করে যে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে এবং ৪র্থ ও ৫ম শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে নতুন, প্রায়োগিক এবং দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
৩.৩. দুর্বল অবকাঠামো এবং ডিজিটাল বিভাজন (Infrastructure and Digital Divide)
গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ চালু থাকলেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় ব্যবহারিক ক্লাসগুলো যথাযথভাবে নেওয়া সম্ভব হয় না। ডিজিটাল যুগেও কিছু শিক্ষার্থী কম্পিউটার সম্পর্কে কোনো ধারণা পাচ্ছে না 
যদিও প্রযুক্তির সংযোজন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো (যেমন: টেন মিনিট স্কুল, খান একাডেমি) জনপ্রিয়তা লাভ করছে 
৩.৪. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)
শিক্ষকদের নিম্ন বেতন ও সামাজিক মর্যাদা 
অন্যদিকে, প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানের অভাব 
অংশ ৪: কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (TVET) এবং কর্মসংস্থানমুখী চ্যালেঞ্জ
৪.১. যুব জনশক্তি এবং কর্মসংস্থানের চাপ (Youth Demographics and Employment Pressure)
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ ভাগ (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) যুব জনশক্তি। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে 
৪.২. টিভিইটি (TVET) ব্যবস্থার দুর্বলতা (Weaknesses of the TVET System)
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (TVET) কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়লেও, এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষতার চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। TVET প্রোগ্রামের গ্রাজুয়েটগণ প্রায়শই তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করলেও শিল্প খাতে চাহিদাসম্পন্ন ব্যবহারিক দক্ষতা প্রদর্শনে মারাত্মকভাবে দুর্বল থাকেন 
এছাড়াও, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, চাকরির সুযোগ এবং শোভন কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও কারিগরি শিক্ষার তাৎপর্য ব্যাপকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি, ফলে তরুণদের বড় অংশের অংশগ্রহণ এখনও অপেক্ষাকৃত কম 
৪.৩. কারিগরি শিক্ষার সামাজিক মর্যাদা ও ভ্রান্ত ধারণা (Low Social Stigma)
কারিগরি শিক্ষার সামাজিক মর্যাদা নেই এবং সাধারণভাবে এটি একটি নেতিবাচক মানসিকতা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে 
৪.৪. নীতিগত অগ্রগতি: দ্বৈত সনদায়ন ব্যবস্থার গুরুত্ব (The Dual Certification Initiative)
টিভিইটি ব্যবস্থার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড TVET প্রোগ্রামে 'দ্বৈত সনদায়ন' (Dual Certification) ব্যবস্থা চালু করতে কাজ করছে, যা NTVQF/BNQF কাঠামোর সাথে সমন্বয়যুক্ত 
৪.৫. দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অন্তর্দৃষ্টি এবং সংযোগ বিশ্লেষণ (Deeper Insights & Causal Analysis)
বাংলাদেশের বিপুল যুব জনশক্তি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু যদি এই জনশক্তিকে প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতা দেওয়া না যায় এবং TVET ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের কর্মক্ষম করা না হয়, তাহলে এই 'যুব লভ্যাংশ' (Demographic Dividend) দ্রুতই 'যুব বোঝায়' (Demographic Burden) পরিণত হবে। দক্ষতা-চাহিদার মধ্যে ফারাক দূর না হলে, দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নষ্ট হবে এবং জাতীয় উৎপাদনশীলতা সীমিত হয়ে পড়বে 
এই প্রেক্ষাপটে, TVET-তে দ্বৈত সনদায়ন 
অংশ ৫: কৌশলগত ও বহুমাত্রিক সমাধান (Strategic and Multi-Layered Solutions)
কাঠামোগত এবং গুণগত সংকট মোকাবেলায় নিম্নলিখিত কৌশলগত ও নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
৫.১. আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুশাসন (Financial Strengthening and Governance)
ক. বরাদ্দ বৃদ্ধি: শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ও ইউনেসকো সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষায় জিডিপি'র কমপক্ষে ৪ শতাংশ ব্যয় করার জন্য সরকারকে দ্রুত একটি সুস্পষ্ট সময়ভিত্তিক রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে 
খ. অর্থায়নের স্বচ্ছতা: বাজেট বরাদ্দের কার্যকারিতা বাড়াতে প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার, দুর্নীতি দমন এবং শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (BANBEIS) এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সঠিক ও নির্ভুল পরিসংখ্যান নিশ্চিত করা 
৫.২. শিক্ষক উন্নয়ন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি (Teacher Development and Professionalization)
ক. বেতন স্কেল পুনর্বিন্যাস ও মর্যাদা: শিক্ষকদের বেতন স্কেলকে 'তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মতো' 
খ. নিবিড় পেশাগত প্রশিক্ষণ (CPD): শিক্ষকদের জন্য নতুন শিক্ষাক্রম, ডিজিটাল শিক্ষণ পদ্ধতি এবং ফলপ্রসূ শিখন-শেখানো কার্যক্রমের উপর নিয়মিত ও নিবিড় পেশাগত প্রশিক্ষণ (CPD) নিশ্চিত করা 
গ. রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এর পরিবর্তে শিক্ষক সমিতি এবং ছাত্র সংসদের মাধ্যমে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক চর্চা ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করা যেতে পারে 
৫.৩. পাঠ্যক্রম সংস্কার এবং দক্ষতা উন্নয়ন (Curriculum Reform and Skill Development)
ক. ফাউন্ডেশনাল শিক্ষা মজবুতকরণ: মৌলিক শিখন সংকটের মোকাবিলায় ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন তৃতীয় শ্রেণির মধ্যে মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যা জ্ঞান অর্জন করতে পারে, তার জন্য একটি জরুরি জাতীয় মিশন চালু করা আবশ্যক 
খ. দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলাম: সার্টিফিকেট-সর্বস্বতা কাটিয়ে উঠতে 
গ. দ্বৈত সনদায়ন (Dual Certification): TVET প্রোগ্রামে NTVQF/BNQF এর সাথে এলাইন করে দ্বৈত সনদায়ন ব্যবস্থার কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা, যাতে গ্রাজুয়েটরা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দক্ষতার জন্য স্বীকৃতি পায় 
৫.৪. ডিজিটাল সমতা ও অবকাঠামো উন্নয়ন (Digital Equity and Infrastructure Development)
ক. গ্রামীণ অবকাঠামো: গ্রামীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ, পরিষ্কার শৌচাগার, নিরাপদ পানি এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রসহ অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করা 
খ. প্রযুক্তির ব্যবহার: উচ্চ সেটআপ ব্যয়বহুল 'স্মার্ট ক্লাসরুম'-এর পরিবর্তে ক্লাউড-ভিত্তিক কন্টেন্ট (যেমন: খান একাডেমি, টেন মিনিট স্কুল) ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সুবিধা প্রান্তিক অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া 
গ. শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের ডিজিটাল শিক্ষণ পদ্ধতি, মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টর ব্যবহার এবং এডুটেক প্ল্যাটফর্ম পরিচালনায় দক্ষ করে তুলতে হবে 
৫.৫. ঝরে পড়া রোধ ও সামাজিক সুরক্ষা (Dropout Prevention and Social Safety Net)
ক. উপবৃত্তি কর্মসূচির সম্প্রসারণ: প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত উপবৃত্তি কর্মসূচির পরিধি বৃদ্ধি এবং অর্থ বিতরণে ডিজিটাল স্বচ্ছতা (ই-স্টাইপেন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে) নিশ্চিত করা 
খ. প্রাথমিক স্তরে মনোযোগ: প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার এখনও উদ্বেগজনক হওয়ায় 
অংশ ৬: উপসংহার এবং ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা (Conclusion and Future Action Plan)
৬.১. প্রধান সুপারিশগুলোর সংক্ষিপ্ত পুনরুল্লেখ
বাংলাদেশের শিক্ষা খাত পরিমাণগতভাবে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করলেও, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং গুণগত মানের সংকট এটিকে কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়নের পথে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। প্রধান কৌশলগত সুপারিশগুলো হলো: ১. শিক্ষা খাতে বিনিয়োগে জিডিপি’র ৪% লক্ষ্যমাত্রা অর্জন; ২. শিক্ষক মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা; ৩. TVET-কে কর্মসংস্থানমুখী করতে দ্বৈত সনদায়ন ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করা; এবং ৪. প্রাথমিক স্তরে মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানের উপর জরুরি জাতীয় মনোযোগ প্রদান করা।
৬.২. বাংলাদেশের জন্য ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে শিক্ষার ভূমিকা (The Roadmap to SDG 4)
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ (SDG 4) পূরণের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রবেশাধিকার (Access) নিশ্চিত করার মডেল থেকে সরে এসে গুণগত মান এবং সমতার (Quality and Equity) উপর জোর দিতে হবে। শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষার মানের ১০ শতাংশ পার্থক্য 
সারণী ২: বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের মূল সূচক এবং বৈষম্য
| সূচক | সাম্প্রতিক তথ্য (বিবিএস/ব্যানবেইস) | শহুরে-গ্রামীণ বৈষম্য | নীতিগত তাৎপর্য | 
| সাক্ষরতার হার (১৫+ বছর) | ৭৭.৭%  | শহর ৮৪.৮%, গ্রাম ৭৪.৬%  | শিক্ষার মানের আঞ্চলিক বৈষম্য জাতীয় মানব পুঁজির ব্যবহারকে সীমিত করছে। | 
| মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার | ৪০.২৯% (২০১৫)  | প্রযোজ্য নয় | ভর্তির হার বাড়লেও, গুণগত মান নিশ্চিত না হওয়ায় এবং অর্থনৈতিক কারণে ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক। | 
| বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ | ১.৪৬% (গত ১২ মাসে)  | প্রযোজ্য নয় | দক্ষতার ঘাটতি পূরণে TVET-এর ব্যাপক অপ্রতুলতা। | 
| ছাত্রীদের অংশগ্রহণ (মাধ্যমিক) | ~৫১%  | প্রযোজ্য নয় | উপবৃত্তি ও সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে অর্জিত উল্লেখযোগ্য জেন্ডার সমতা। | 
0 Comments