ব্রেকিং নিউজ

6/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা: আদর্শিক প্রত্যাশা ('জুলাই সনদ') এবং অন্তর্বর্তীকালীন বাস্তবতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা: আদর্শিক প্রত্যাশা ('জুলাই সনদ') এবং অন্তর্বর্তীকালীন বাস্তবতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ সৃষ্টি করেছে, যা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলশ্রুতি। এই অভ্যুত্থানের মূল ম্যান্ডেট ছিল কেবল ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, বরং রাষ্ট্র কাঠামোতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করা, যা 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫'-এ একটি আদর্শিক রূপরেখা লাভ করেছে । এই সনদে ক্ষমতার পৃথকীকরণ, সাংবিধানিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার, প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা এবং তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।   

বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ট্রানজিশনাল কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করছে, যার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে । তবে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার চলমান ঘটনা দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিগত সংস্কারের পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে    

কেন্দ্রীয় চ্যালেঞ্জটি হলো আদর্শিক প্রতিশ্রুতি (জুলাই সনদের মাধ্যমে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ব্যাপক সাংবিধানিক সংস্কারের অঙ্গীকার)  এবং বিদ্যমান গভীর শিকড়যুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন। এই প্রতিবেদনে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী আদর্শিক শাসনব্যবস্থার চাহিদা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন শাসন ব্যবস্থার বাস্তব পরিস্থিতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।   

ক. পরিপ্রেক্ষিত: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষয় এবং গণঅভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট

A. বিগত দেড় দশকের শাসনতান্ত্রিক সংকট: সাংবিধানিক বিকৃতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

দীর্ঘ ৫৩ বছরেও বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের নীতির ভিত্তিতে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো অর্জন করতে পারেনি । গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশ বারবার হোঁচট খেয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, বরং সেগুলো নামেমাত্র থাকলেও দুর্বলভাবে কাজ করেছে    

২০০৯ সালে একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করতে শুরু করে । রাষ্ট্র কাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর এবং বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে । এই সময়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয় । এই স্বৈরতান্ত্রিক পরিবেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার হরণ, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন এবং মামলার মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল    

B. অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা: সুশাসন ও রাষ্ট্র কাঠামোর পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক সুযোগ

এই পটভূমিকায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এক অভূতপূর্ব সফল গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশোর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হওয়ার মাধ্যমে এই সুযোগ অর্জিত হয় । জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়    

এই গণঅভ্যুত্থান জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি করে। এই ঐতিহাসিক সুযোগের মূল ম্যান্ডেট হলো রাষ্ট্র সংস্কার, যার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং একটি সুশাসিত, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা । এই ম্যান্ডেট কেবল একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি নতুন অধ্যায় সূচনার জন্য অপরিহার্য, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে    

খ. আদর্শিক প্রত্যাশা: কেমন শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল? ('জুলাই জাতীয় সনদ' অনুযায়ী)

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় শাসন ব্যবস্থা হলো এমন একটি কাঠামো, যা ক্ষমতার পৃথকীকরণ, কার্যকর চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেকোনো এককেন্দ্রিক স্বৈরাচারী প্রবণতাকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। এই আদর্শিক রূপরেখাটি 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫'-এ তুলে ধরা হয়েছে    

A. ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং সাংবিধানিক ভারসাম্য

জুলাই সনদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে, বিশেষ করে আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার্থে।

১. শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা

জুলাই সনদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংবিধানে এরূপ বিধান যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন । এই প্রস্তাবনাটি পরোক্ষভাবে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Bicameral Legislature) প্রবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।   

যদি রাষ্ট্রপতি কেবল নিম্নকক্ষের ভোটে নির্বাচিত হতেন, তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে পারতেন না, কারণ নিম্নকক্ষে ক্ষমতাসীন দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে। উভয় কক্ষের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্রের প্রধান নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল নন, যা সংসদের একচ্ছত্র ক্ষমতা সীমিত করার এবং নির্বাহী ও আইনসভার মধ্যে ভারসাম্য আনার আদর্শিক প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এটি ক্ষমতার পৃথকীকরণের আদর্শকে শক্তিশালী করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ    

২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ

বিগত দেড় দশকের শাসনের প্রধান দুর্বলতা ছিল বিচার বিভাগের দলীয়করণ। এই প্রবণতা মোকাবেলায় জুলাই সনদে বিধান করা হয়েছে যে, বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশকে 'অসদাচরণ' হিসেবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান করা হবে (ধারা ৫১) । এটি কেবল বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে নির্বাহী বিভাগ থেকে মুক্ত করার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দেয় না, বরং বিচারকদের ব্যক্তিগত আচরণবিধিকেও আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার জন্য বাধ্যতামূলক করে।   

এছাড়াও, বিচারিক অবকাঠামো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখা হয়েছে । এই পদক্ষেপগুলো বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করবে।   

B. নির্বাচন ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা

গণঅভ্যুত্থানের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংস। আদর্শিক শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন (EC) অপরিহার্য।

১. নির্বাচন কমিশন নিয়োগ পদ্ধতি সংস্কার

বিদ্যমান সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে । প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাছাই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্য হবেন: জাতীয় সংসদের স্পিকার (যিনি প্রধান হবেন), ডেপুটি স্পিকার (যিনি বিরোধী দল হতে নির্বাচিত হবেন), প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসাবে আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি    

এই বাছাই কমিটিতে ক্ষমতাসীন দল (প্রধানমন্ত্রী) এবং বিরোধী দলের নেতা উভয়ের উপস্থিতি আবশ্যকীয় করে, যা EC নিয়োগে ঐকমত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। স্পিকারের তত্ত্বাবধানে সংসদীয় সচিবালয় এই কমিটিকে সহায়তা করবে। সংসদ কর্তৃক আইন প্রণীত হবে, যেখানে কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা, প্রার্থী অনুসন্ধানের পদ্ধতি এবং জবাবদিহিতার জন্য আচরণ বিধি লিপিবদ্ধ থাকবে । এটি নিশ্চিত করে যে EC নিয়োগ কেবল রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, বরং সাংবিধানিক ও আইনি দক্ষতার ভিত্তিতে হবে, যা ভবিষ্যতের নির্বাচনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার আদর্শিক ভিত্তি স্থাপন করে।   

২. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ

নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণে দলীয় প্রভাবমুক্ত পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হিসেবে প্রতি আদমশুমারি বা অনধিক ১০ বছর পরে সংসদীয় নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে    

C. স্থানীয় সরকার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

আদর্শিক শাসন ব্যবস্থার জন্য কেবল কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারই যথেষ্ট নয়; ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization) হলো একনায়কতন্ত্র প্রতিরোধের চূড়ান্ত সাংবিধানিক সুরক্ষা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০ এ স্থানীয় সরকারের রূপরেখা রয়েছে, যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে    

গণতন্ত্র এবং স্থানীয় সরকারের দাবিকে "পরস্পর গতিময়" (mutually dynamic) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । এর অর্থ হলো, স্থানীয় সংস্থার প্রতিনিধিরা গণতান্ত্রিক ধারণার ভিত্তিতে জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরতে পারে। জুলাই সনদে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন এবং জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সংস্থাকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়েছে । অতীতে স্থানীয় সরকারে স্বায়ত্তশাসনের অভাব ছিল কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার একটি প্রধান হাতিয়ার; তাই আদর্শিক শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কার্যকর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা জরুরি    

D. সুশাসন ও দুর্নীতি দমন

জুলাই সনদের আদর্শিক লক্ষ্য পূরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি প্রধান স্তম্ভ। এর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে সংশোধন, কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার এবং নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে । বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে    

গ. বর্তমান বাস্তবতা: অন্তর্বর্তীকালীন শাসন কাঠামোর প্রকৃতি ও কার্যক্রম

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি ট্রানজিশনাল কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করছে। এই সরকারের মূল লক্ষ্য স্বল্প সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করা এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ তৈরি করা।

A. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক অবস্থান ও আইনি ভিত্তি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল, যা সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা পেয়েছিল । বর্তমান সরকার জনগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত হলেও, এর কার্যক্রমকে ভবিষ্যতে আইনি চ্যালেঞ্জ থেকে সুরক্ষা দিতে সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজন হবে, যদিও 'জুলাই জাতীয় সনদ'  আইনি সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছে।   

এই সরকার বর্তমানে যে আইনি শূন্যতার মধ্যে কাজ করছে, তা তার de jure (আইনি) বৈধতা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরে। জনগণ কর্তৃক de facto (বাস্তবিক) সমর্থন থাকলেও, এই ট্রানজিশনাল সরকারের কার্যক্রমের চূড়ান্ত আইনি সুরক্ষা জুলাই সনদের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ন্যস্ত । অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ২০২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে    

B. কাঠামোগত সংস্কারের অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন এবং জবাবদিহিতার দিকে এগিয়ে এসেছে । সরকার বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে, যা সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (NCC) ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে 'জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫' চূড়ান্ত করেছে এবং দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে    

এছাড়াও, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুশাসন এবং শান্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকার 'নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন' গঠন করেছে। এই কমিশন ডিসেম্বরে ২০২৪ সালে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে জাতীয় জনমত জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে    

ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সরকার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা বাতিল করেছে, যার মধ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাও রয়েছে । সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুম বন্ধের দাবি জানিয়েছে । জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন এবং বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে    

C. মানবাধিকার ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন (HRW রিপোর্ট)

যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে এসেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে জোর দেয়    

বিগত দেড় দশক ধরে নিরাপত্তা বাহিনী সমালোচক ও বিরোধী দলের সদস্যদের দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছিল, যার ফলে পুলিশ "ক্রমশ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে, বছরের পর বছর ধরে দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করে" । অভ্যুত্থানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে তাজা গুলি চালিয়ে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নজির স্থাপন করে । এই গভীর প্রাতিষ্ঠানিক দলীয়করণ রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না, যা সংস্কারের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।   

HRW অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইনগতভাবে আটক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আইন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া, স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় এবং অন্যান্য জাতিসংঘের অধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন চাওয়া । এটি অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাকে কাটিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়ার গতি ও গুণমান বজায় রাখতে সহায়ক হবে। 

ঘ. মূল প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আদর্শ বনাম বাস্তবতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী আদর্শিক চাহিদা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট তুলনা বিদ্যমান। এই তুলনাটি শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য সংস্কারের গতি এবং প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

প্রাতিষ্ঠানিক খাতগণঅভ্যুত্থানের আদর্শিক চাহিদা ('জুলাই সনদ' প্রস্তাবনা)অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও বর্তমান বাস্তবতা
নির্বাচন কমিশন (EC)

নিয়োগে ঐকমত্যভিত্তিক বাছাই কমিটি গঠন (স্পিকার, পিএম, বিরোধী দলীয় নেতা, বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধি সমন্বয়ে) এবং সংসদীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ 

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন; জনমত জরিপ প্রক্রিয়াধীন ; দ্রুত নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা (২০২৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে) 

বিচার বিভাগ

বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্যকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা (ধারা ৫১); সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা 

বেশ কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার; বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবির ঘোষণা 

স্থানীয় সরকার

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন এবং জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা; স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা 

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের প্রতিশ্রুতি ; মাঠ পর্যায়ে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক পদক্ষেপ (ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে) প্রক্রিয়াধীন।

নিরাপত্তা ও প্রশাসন

ক্ষমতা পৃথকীকরণ; পুলিশ, সামরিক বাহিনী, সিভিল সার্ভিসে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা 

প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের দিকে অগ্রগতি; তবে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা (নির্বিচারে গ্রেপ্তার, সহিংসতা) এখনো উদ্বেগের কারণ 

সাংবিধানিক ও শাসন ব্যবস্থা

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থার ইঙ্গিত সহ রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতির সংশোধন; সংস্কার বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকারের ২ বছরের অঙ্গীকার 

ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক সনদ চূড়ান্তকরণ ; বর্তমান শাসন ব্যবস্থা অন্তর্বর্তীকালীন ও ট্রানজিশনাল প্রকৃতির।

 

সারণি ১: প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: আদর্শিক লক্ষ্য বনাম বর্তমান অগ্রগতি (২০২৫)

A. বিশ্লেষণ: সংস্কারের গতি ও স্থিতিশীলতার ঝুঁকি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একদিকে যেমন দ্রুত একটি নির্বাচন নিশ্চিত করতে চাইছে , অন্যদিকে 'জুলাই সনদ' দাবি করে দীর্ঘমেয়াদী, কাঠামোগত পরিবর্তন (যেমন সংবিধান সংশোধন) যার জন্য পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের দুই বছর সময় লাগবে । এই পরিস্থিতি নির্দেশ করে যে, ম্যান্ডেট পূরণ করতে হলে সরকারকে একটি গভীর সংস্কারের পথ তৈরি করতে হবে, যা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।   

এই আদর্শিক পথে সবচেয়ে বড় পার্থক্য তৈরি করেছে নিরাপত্তা খাতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানালেও , নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা চলমান থাকা প্রমাণ করে যে নিরাপত্তা কাঠামোর গভীরে থাকা দলীয় আনুগত্য এবং জবাবদিহিতার অভাব দূর করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া । যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্রুত নিরপেক্ষ না হয়, তবে এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করবে। নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার না হলে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অপব্যবহার করার প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকবে না।   

ঙ. সংস্কার বাস্তবায়নের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ও টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

A. 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নে আইনি ও সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা

জুলাই সনদের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ওপর। এই সনদের মূল প্রতিশ্রুতি হলো, সনদ গৃহীত হওয়ার পরে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন এবং বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন/পুনর্লিখন সম্পন্ন করতে হবে    

অতীতের স্বৈরাচারী প্রবণতা দেখায়, ক্ষমতা হাতে পেলে দলগুলো প্রায়শই সংস্কারের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে । যেহেতু সংস্কারের অধিকাংশ কাজ পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের হাতে ন্যস্ত, তাই প্রধান চ্যালেঞ্জটি হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য বজায় রাখা। 'জুলাই সনদের' সাফল্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে এই অঙ্গীকারের আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার ওপর । লক্ষণীয় যে, জুলাই সনদের দ্বিতীয় পর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি সহ কয়েকটি দলের ভিন্নমত ছিল । এই ভিন্নমত ভবিষ্যতে সাংবিধানিক বিতর্ক তৈরি করতে পারে, যা সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার ঝুঁকি রাখে।   

সংস্কারের ক্ষেত্রমূল প্রস্তাবনা/ধারা (উদাহরণ)বাস্তবায়ন সময়সীমা
শাসন ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার

সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে প্রস্তাব/সুপারিশ বাস্তবায়ন 

পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে 

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

আইনসভার উভয় কক্ষের (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচন 

পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে 

নির্বাচন কমিশন নিয়োগ

বাছাই কমিটি (স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, পিএম, বিরোধী দলীয় নেতা, বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধি) দ্বারা নিয়োগ 

পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শনকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ 

পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে 

  

সারণি ২: জুলাই জাতীয় সনদের (২০২৫) মূল সংস্কার প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি

B. দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের ভূমিকা

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর সাফল্য নির্ভর করবে তাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কতটা বাস্তবে রূপ দেওয়ার সক্ষমতার উপর । এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বিগত দেড় দশকের শাসনের ফলে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতির প্রতি যে গভীর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে হলে ট্রানজিশনাল জাস্টিস নিশ্চিত করা অপরিহার্য।   

জুলাই সনদে গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব  ট্রানজিশনাল জাস্টিসের ধারণাকে শক্তিশালী করে। ট্রানজিশনাল জাস্টিস নিশ্চিত করা না হলে, রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কেবল নির্বাচনী সংস্কারই যথেষ্ট নয়, বিগত স্বৈরাচারী শাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে তা ভবিষ্যতের যেকোনো সরকারকে অস্থিতিশীল করবে    

C. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব

যেহেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন) পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক দুর্বল করা হয়েছিল , সংস্কার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। স্থায়ীভাবে সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় এবং অন্যান্য জাতিসংঘের অধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন চাওয়া । আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংস্কারের গতি এবং গুণমান নিশ্চিত করা গেলে তা সংস্কার বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বজায় রাখতে সহায়ক হবে।   

চ. উপসংহার ও বিশেষজ্ঞ সুপারিশমালা 

A. উপসংহার: আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধন

বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার আদর্শিক প্রয়োজনীয়তা হলো একটি সুচিন্তিত, সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পুনর্গঠন, যা 'জুলাই জাতীয় সনদ'-এ বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ। এই রূপরেখাটি একটি কার্যকর গণতন্ত্র, যেখানে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়েছে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই আদর্শিক পথে যাত্রা শুরু করলেও, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা পূরণে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কাঠামোতে বিরাজমান দলীয় আনুগত্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আদর্শিক লক্ষ্য এবং বাস্তবতার মধ্যে প্রধান ব্যবধান সৃষ্টি করেছে।

চূড়ান্তভাবে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট এই ঐতিহাসিক সুযোগের সদ্ব্যবহার নির্ভর করছে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের মধ্যে সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের ওপর। যদি 'জুলাই সনদের' প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পরবর্তী সরকার দুই বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার সম্পন্ন করতে পারে, তবেই বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

B. বিশেষজ্ঞ সুপারিশমালা

পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, বাংলাদেশে টেকসই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অপরিহার্য:

১. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনি সুরক্ষা: পরবর্তী নির্বাচনের আগেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেটকে সাংবিধানিক সংশোধনী (১৯৯১ সালের ঘটনার অনুরূপ ) অথবা সংসদীয় রেজোলিউশনের মাধ্যমে আইনি সুরক্ষা দেওয়া উচিত, যাতে এর গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো ভবিষ্যতের আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে।   

২. নিরাপত্তা খাতের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা: নিরাপত্তা খাত সংস্কারের জন্য একটি নিরপেক্ষ স্বাধীন কমিশন দ্রুত গঠন করা প্রয়োজন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, বিশেষত নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনার ক্ষেত্রে দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি হয়    

৩. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ: স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী , সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন করা উচিত। কার্যকর স্বায়ত্তশাসন এবং জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে কেবল একটি ধারণায় সীমাবদ্ধ না রেখে প্রশাসনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।   

৪. রাজনৈতিক অঙ্গীকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ: জুলাই সনদের বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তা বজায় রাখার জন্য সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা জরুরি। জনআকাঙ্ক্ষা যাতে প্রতিফলিত হয়, সেজন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে জাতীয় জনমত জরিপের  ফলাফলকে সাংবিধানিক সংস্কারের একটি অপরিহার্য ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা এবং এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।   

asset.kalerkantho.com
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ (খসড়া) - Kaler Kantho
Opens in a new window
bssnews.net
জুলাই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন | শিরোনাম - BSS
Opens in a new window
hrw.org
বাংলাদেশ: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কার প্রয়োজন | Human ...
Opens in a new window
kalbela.com
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন দলগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ - কালবেলা
Opens in a new window
cdn.jagonews24.com
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সুদীর্ ঘ গণতান্ত্রিক সংগ - Jagonews24
Opens in a new window
prothomalo.com
জুলাই সনদে কী কী সংস্কার প্রস্তাব থাকছে | প্রথম আলো
Opens in a new window
lgd.gov.bd
- - স্থানীয় সরকার বিভাগ-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Opens in a new window
banglatribune.com
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আইন কী বলে - Bangla Tribune
Opens in a new window
bssnews.net
১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন: শফিকুল আলম - BSS
Opens in a new window

Post a Comment

0 Comments