বাংলাদেশ পুলিশের কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ এবং জনবান্ধব পুলিশিংয়ে রূপান্তরের কৌশলগত রূপরেখা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ একটি অপরিহার্য জাতীয় সংস্থা 
একটি সত্যিকারের জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরের জন্য কেবল রুটিন মাফিক পরিবর্তন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন কাঠামোগত এবং দার্শনিক সংস্কার। এই সংস্কারের কেন্দ্রে রয়েছে ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক আইনের প্রতিস্থাপন, যা নিয়ন্ত্রণকে সেবার চেয়ে প্রাধান্য দেয় 
ভূমিকা: বাংলাদেশের পুলিশিংয়ের ঐতিহাসিক ও আইনি প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ পুলিশের মূল ম্যান্ডেট, আদর্শ ও বহুমাত্রিক ভূমিকা
বাংলাদেশ পুলিশ হলো দেশের জাতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় 
আইনগত ভিত্তি: ১৮৬১ সালের ঔপনিবেশিক পুলিশ আইনের প্রভাব
বাংলাদেশ পুলিশের আইনি ভিত্তি বহুলাংশে ঔপনিবেশিক যুগের পুলিশ আইন, ১৮৬১ 
আধুনিক পুলিশিংয়ের মূল দর্শন হলো জনগণের সেবা করা, কিন্তু ঔপনিবেশিক আইনটি পুলিশকে 'সেবাদানকারী' প্রতিষ্ঠানের চেয়ে 'নিয়ন্ত্রণকারী' প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে 
বর্তমান কার্যপ্রণালী, দক্ষতা ও আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা
সাংগঠনিক বিন্যাস, বিশেষায়িত ইউনিট এবং ক্ষমতা প্রয়োগ
বাংলাদেশ পুলিশ একটি বিশাল বাহিনী, যার কর্মী সংখ্যা প্রায় ২,১৪,০০০ জন 
পুলিশ কর্মকর্তা এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্তব্যও আইনে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: রাস্তাঘাটে দৈহিকভাবে অক্ষম ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদান, গ্রেফতারকৃত আহত বা অসুস্থ ব্যক্তির জন্য দ্রুত সাহায্য নিশ্চিত করা, তল্লাশির সময় দুর্ব্যবহার পরিহার করা, এবং মহিলা ও শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারের সময় কঠোরভাবে শালীনতাপূর্ণ আচরণ ও ভদ্রতা বজায় রাখা 
আধুনিকীকরণ ও জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বেশ কিছু প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন করেছে। এই প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে:
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন: '৯৯৯' সেবা চালুর মাধ্যমে নাগরিকেরা এখন জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশের সেবা সহজেই পাচ্ছেন 
জেন্ডার সংবেদনশীলতা: জেন্ডার সংবেদনশীলতা প্রসারের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (SOP) প্রবর্তন করা হয়েছে, যা পুলিশের প্রতিটি ইউনিটে প্রতিপালিত হচ্ছে 
অভ্যন্তরীণ পেশাদারিত্ব: অধস্তন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় মেধা ও যোগ্যতার সমতা নিশ্চিত করতে ২০২০ সাল থেকে এটি কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং মেধাতালিকাও কেন্দ্রীয়ভাবে প্রণয়ন করা হচ্ছে 
জাতীয় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা
জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ নিয়মিতভাবে কাজ করে চলেছে। পুলিশ জঙ্গিবাদ দমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে, যার ফলস্বরূপ কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (CTTC) ইউনিট গঠন, জঙ্গি আস্তানা নিশ্চিহ্ন করা এবং সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে 
এই সকল আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা—যেমন ৯৯৯ সেবা চালু করা বা কেন্দ্রীয় পদোন্নতি প্রক্রিয়া—পুলিশের অভ্যন্তরীণ দক্ষতা এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করলেও, তা জনগণের আস্থা অর্জনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। এই পরিবর্তনগুলো প্রধানত পুলিশের "পেশী" এবং "সুবিধা" এর সংস্কার, কিন্তু এটি বাহিনীর "আত্মা" বা জবাবদিহিতার সংস্কৃতির সংস্কার নয় 
জনবান্ধব হওয়ার পথে প্রধান কাঠামোগত অন্তরায়সমূহ
বাংলাদেশ পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঔপনিবেশিক আইনি কাঠামো এবং রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব সৃষ্টিকারী কাঠামোগত অন্তরায়সমূহ।
রাজনৈতিক প্রভাব এবং পুলিশের অ-পেশাদারিত্ব
পুলিশ বাহিনীর একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন থাকা। স্বাধীনতা লাভের শুরু থেকেই ক্ষমতাশীল প্রতিটি সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি, প্রতিশোধমূলক মামলা দায়ের, এমনকি নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে 
এই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পুলিশের অভ্যন্তরীণ পেশাদারত্বকে গভীরভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রায়শই অভিযোগ ওঠে যে পুলিশের পদোন্নতি যোগ্যতা বা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্য দিয়ে নির্ধারিত হয় 
ব্যাপক দুর্নীতি ও আস্থাহীনতার সংকট
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফলস্বরূপ, পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতি একটি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) ২০০২ এবং ২০১৩ সালেও পুলিশকে দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল 
দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলো কেবল ঘুষ গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঘুষ, নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণ ও হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে 
জবাবদিহিতার অভাব ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি
পুলিশের অ-পেশাদারিত্বের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো দায়মুক্তির (Impunity) সংস্কৃতি। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুম, এবং নিষ্ঠুর বা অমানবিক আচরণের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে 
এই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি একটি চক্র তৈরি করেছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পুলিশ সদস্যদেরকে সুরক্ষা দেয়, যা তাদেরকে আইন লঙ্ঘনে উৎসাহিত করে। সরকার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও এই অভিযোগগুলো অব্যাহত থাকে 
এছাড়াও, ফৌজদারি কার্যবিধির বিতর্কিত ধারা, যেমন: ৫৪ (বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার) এবং ১৬৭ (রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ), এর অপব্যবহারের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে 
জনবান্ধব পুলিশিংয়ের পথে মূল প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা ও প্রস্তাবিত সমাধান
| প্রতিবন্ধকতা (Current Challenge) | উৎস | প্রস্তাবিত কাঠামোগত সমাধান (Structural Reform) | উৎস | 
| ঔপনিবেশিক আইন (পুলিশ আইন ১৮৬১) কর্তৃক "নিয়ন্ত্রণ" ম্যান্ডেট | একটি নতুন, জনমুখী, সার্বভৌম পুলিশ আইন প্রণয়ন | ||
| নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ | স্বাধীন পুলিশ কমিশন (IPC) গঠন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ | ||
| দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়মুক্তি | স্বাধীন অভিযোগ কমিশন স্থাপন (বহিরাগত নিরীক্ষা) | ||
| ফৌজদারি কার্যবিধির (৫৪, ১৬৭) ধারাগুলির অপব্যবহার | আইনি সংস্কার ও গ্রেফতারের প্রক্রিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ | ||
| জনগণের আস্থাহীনতা ও পুলিশি কর্মকাণ্ডে অনীহা | কার্যকর কমিউনিটি/বিট পুলিশিং ও মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি | 
জনবান্ধব পুলিশিং ধারণার বিশ্লেষণ এবং কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যকারিতা
জনবান্ধব পুলিশিংয়ের দার্শনিক ভিত্তি
জনবান্ধব পুলিশিং (Citizen-Centric Policing), যা কমিউনিটি পুলিশিং (CP) নামেও পরিচিত, তা হলো একটি সংগঠনভিত্তিক দর্শন এবং ব্যবস্থাপনাগত পদ্ধতি। এটি জনগণ, সরকার ও পুলিশের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অপরাধ দমন, অপরাধভীতি হ্রাস এবং সামাজিক সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেয় 
আধুনিক পুলিশিংয়ের মূলনীতি অনুযায়ী, পুলিশের কর্তব্য হলো অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা। এই কর্তব্য পালনের ক্ষমতা নির্ভর করে জনগণের অনুমোদন এবং জনগণের আস্থা অর্জন ও তা বজায় রাখার ওপর 
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের উদ্দেশ্য, সফলতা ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং প্রবর্তন করা হয়েছে প্রধানত পুলিশের বৈধতা বাড়ানো, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ উন্নত করা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সম্পদ ও জনগণের সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে 
অপরাধ হ্রাস: ওপেন হাউজ ডে, মতবিনিময় সভা, উঠান বৈঠক এবং দৃশ্যমান টহলের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে 
সামাজিক প্রতিরোধ: মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কমিউনিটি পুলিশিং কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে 
তবে, কমিউনিটি পুলিশিং বাস্তবায়নে গুরুতর সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। প্রথমত, স্থানীয় পুলিশের প্রতি এলাকার জনগণের আস্থার অভাব এবং সন্দেহ সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা 
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা হলো পুলিশ বাহিনীর কাঠামোতে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। অনেক পুলিশ সদস্য এটিকে তাদের রুটিন ডিউটির বাইরে একটি 'ঐচ্ছিক বিষয়' বা 'বাড়তি ঝামেলা' মনে করেন এবং এতে প্রয়োজনীয় শ্রম বা মেধা দেন না 
বাংলাদেশে কমিউনিটি পুলিশিং প্রায়শই একটি মৌলিক দর্শন (Philosophy) হিসেবে কাজ না করে, নিছক একটি জনসংযোগ বা বাহ্যিক "কার্যক্রম" (Activity) হিসেবে পরিচালিত হয় 
জনবান্ধব পুলিশিংয়ের জন্য কৌশলগত সংস্কারের রূপরেখা
জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে হলে যুগোপযোগী, সুসংগঠিত এবং বহুমুখী সংস্কার বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। এই সংস্কারে আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক ও সংস্কৃতিগত পরিবর্তন একইসাথে সাধন করতে হবে।
আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
১. ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের প্রতিস্থাপন
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন, পূর্ণাঙ্গ এবং জনমুখী পুলিশ আইন প্রণয়ন করা সবচেয়ে জরুরি 
২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন (Independent Police Commission - IPC) গঠন
পুলিশকে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা জরুরি 
এই কমিশন পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন, পদাবনতি (পুরস্কার ও শাস্তি) ইত্যাদি বিষয়গুলোর নীতিমালা প্রণয়ন ও পরিচালনা করবে 
৩. স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণ
পুলিশের কার্যক্রমে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী ইউনিটগুলিকে কার্যক্রমে স্বাধীনতা প্রদান করা উচিত, যাতে তারা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে 
জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা
১. স্বাধীন অভিযোগ কমিশন (Independent Complaints Commission - ICC) স্থাপন
পুলিশ সদস্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন, বহিরাগত তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক 
২. দায়মুক্তির অবসান ও মানবাধিকার সুরক্ষা
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দ্রুত, নিরপেক্ষ ও সুচারুভাবে তদন্ত করে দোষী পুলিশ সদস্যদের কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে 
মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি
১. উন্নত নৈতিকতা ও মানবাধিকার প্রশিক্ষণ
পুলিশ সদস্যদের অবশ্যই নৈতিকতা, মানবাধিকার, পেশাদার আচরণ, এবং জনগণের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দিতে হবে 
২. কল্যাণমূলক ব্যবস্থা এবং মানসিক সহায়তা
পুলিশ সদস্যরা প্রায়শই সাপ্তাহিক ছুটি বা নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করলেও ওভারটাইম পান না 
কার্যকর কমিউনিটি এনগেজমেন্ট
কমিউনিটি পুলিশিংকে কেবল একটি ঐচ্ছিক কার্যক্রম হিসেবে নয়, বরং পুলিশি রুটিন ডিউটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে 
আধুনিক পুলিশিংয়ে স্থানান্তরের নীতিগত স্তম্ভ
| বৈশিষ্ট্য | ঔপনিবেশিক মডেল (Police Act 1861-driven) | প্রস্তাবিত জনবান্ধব মডেল (Citizen-Centric Model) | 
| প্রধান উদ্দেশ্য | রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ (Control) ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা  | জনগণের নিরাপত্তা ও সেবা (Service) প্রদান  | 
| জবাবদিহিতা কর্তৃপক্ষ | অভ্যন্তরীণ (মন্ত্রণালয়/ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে) | স্বাধীন কমিশন ও নাগরিক সমাজের কাছে বহিরাগত জবাবদিহিতা  | 
| নিয়োগ/পদোন্নতির ভিত্তি | রাজনৈতিক আনুগত্য এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত  | মেধা, যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও সততা; স্বাধীন কমিশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত  | 
| পেশাদারত্বের মানদণ্ড | আদেশ পালন ও আইন-শৃঙ্খলা (Command and Control) | মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, নৈতিকতা ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা  | 
| জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক | ভয় ও দূরত্ব বজায় রাখা (ভয়ের প্রতীক)  | আস্থা ও সহযোগিতা (ভরসার আশ্রয়স্থল)  | 
পুলিশ সংস্কারের সাফল্য বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা এবং দুর্নীতি দমনের স্বাধীনতার উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। যদি পুলিশকে একটি স্বাধীন কমিশন দ্বারা জবাবদিহির আওতায় আনা হয়, কিন্তু বিচারিক প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয় (যেমন ফৌজদারি কার্যবিধির বিতর্কিত ধারাগুলোর সংস্কার না হলে), তবে দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না 
উপসংহার ও চূড়ান্ত সুপারিশমালা
বাংলাদেশ পুলিশকে একটি আধুনিক, জনবান্ধব এবং পেশাদার বাহিনীতে রূপান্তর করতে হলে ঔপনিবেশিক আইনি কাঠামোর পরিবর্তন, রাজনৈতিক প্রভাবের অবসান এবং কাঠামোগত জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। যদিও পুলিশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করেছে, জনগণের আস্থা অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি 
জনবান্ধবতার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এমন একটি পুলিশ বাহিনী তৈরি করা, যা অস্ত্র বা ক্ষমতার মাধ্যমে নয়, বরং জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে শক্তিশালী হবে 
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, এই রূপান্তরের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারমূলক সুপারিশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত:
১. স্বাধীন ও শক্তিশালী আইনি কাঠামো: পুলিশ আইন, ১৮৬১ এর পরিবর্তে একটি যুগোপযোগী, সেবামুখী আইন প্রণয়ন এবং ফৌজদারি কার্যবিধির (৫৪ ও ১৬৭) বিতর্কিত ধারাগুলির সংস্কার 
২. স্বাধীন পুলিশ কমিশন (IPC): রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন 
৩. স্বাধীন অভিযোগ কমিশন (ICC): পুলিশ সদস্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন, বহিরাগত অভিযোগ কমিশন স্থাপন 
৪. মানবাধিকারভিত্তিক প্রশিক্ষণ: নৈতিকতা, মানবাধিকার, এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার উপর জোর দিয়ে পুলিশ সদস্যদের বিশেষায়িত ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা 
৫. দায়মুক্তির অবসান: গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতনসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দ্রুত তদন্ত করে দোষী পুলিশ সদস্যদেরকে কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা 
0 Comments